• ‘এঞ্জেল ইস ওয়াচিং ইউ’: ভিক্টোরিয়ার পরি
    এই সময় | ০২ আগস্ট ২০২৩
  • গৌতম বসুমল্লিক Victoria Memorial Ticket : ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। গড়ের মাঠের জেলখানা সরিয়ে তৈরি হয় এই স্মৃতিসৌধ। একটু জোরে হাওয়া দিলেই বিভিন্ন দিকে ঘুরে যায় ভিক্টোরিয়া পরি। জর্জ অরওয়েলের ১৯৩৯ সালে লেখা ‘1984’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত ‘বিগ ব্রাদার ইস ওয়াচিং ইউ’ স্লোগানটার কথা মনে পড়ে? ওই উপন্যাস লেখারও অন্তত আঠারো বছর আগে প্রায় সেই রকমই একটা স্লোগান উঠেছিল গত শতকের বিশের দশকের গোড়ায় কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির পর। কিন্তু কেন? কারণ হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের মূল গম্বুজের উপরে বসানো সেই বিখ্যাত ‘পরি’!

    বিশাল আকার সৌধের প্রধান হলের ঠিক মাথায় রয়েছে একটা গম্বুজ আর গম্বুজের বাইরের দিকে একটা পারা বা মার্কারি দিয়ে ভরা ব্রোঞ্জের গ্লোব। গ্লোবের উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাড়ে ছয় টন ওজনের ব্রোঞ্জের তৈরি এক নারীমূর্তি, বাঁ হাতে একটি লম্বা শিঙা ফুঁকছে। ডান হাতে একগুচ্ছ ফুল, পেছনে দুটো পাখা। মূর্তির বৈশিষ্ট হল, একটু জোরে হাওয়া দিলেই সে ঘুরে যায় বিভিন্ন দিকে। আর তাই নিয়েই সে যুগে তৈরি হয়েছিল নানা গুজব। শোনা যায়, কেউ কেউ রটিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এঞ্জেল ইস ওয়াচিং ইউ’। অর্থাৎ ওই পরি নাকি ব্রিটিশদের চর। ২০০ ফুট উঁটু থেকে চারিদিক ঘুরে কলকাতাবাসীদের উপর নজর রাখছে।

    ১৯০১ সাধারণাব্দের জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু হয়। লন্ডন থেকে মৃত্যু সংবাদের টেলিগ্রাম তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতার লাটভবনের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। পরের দিন থেকেই দেশের অভিজাত সম্প্রদায় রানির মৃত্যুতে শোক পালনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। বাঙালিও অংশ নিল সেই শোক পালনের প্রতিযোগিতায়। পাথুরিয়াঘাটার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে

    হিন্দু পারলৌকিক বিধি অনুসারে মৃত্যুর তারিখ থেকে বারো দিনের দিন সঙ্গীত সমাজের ব্যবস্থাপনায় অসংখ্য মানুষ মাতৃবিয়োগের সমান শোকচিহ্ন অর্থাৎ সাদা ধুতি ও সাদা উত্তরীয় পরে খালিপায়ে গড়ের মাঠে কীর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করল। পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট অর্থাৎ, বর্তমান বিধান সরণির উপর বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থল থেকে মেছুয়াবাজার স্ট্রিট অর্থাৎ, বর্তমান কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিট পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তার উপর ফুটপাথ ধরে চারটি সারিতে কাঙালি ভোজন বা দরিদ্রনারায়ণ সেবা করানো হল। মেনু ছিল— খিচুড়ি, কপির তরকারি, দই, বোঁদে এবং ভীমনাগের দেওয়া সন্দেশ। খিচুড়ি তৈরি করতে লেগেছিল, সাড়ে চার টাকা মণ দামের দেড় শো মণ বালাম চাল, সেই পরিমাণ ডাল, ১২ মণ ঘি, হলুদ, লঙ্কা প্রভৃতি মশলা।

    সেই সময়ে ভারতের গর্ভনর জেনারেল ছিলেন লর্ড কার্জন। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে ভিক্টোরিয়ান যুগের নানা শিল্পবস্তু দিয়ে সাজানো এক স্মৃতিসৌধ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নাম হবে ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল’। ময়দানের দক্ষিণ অংশে ক্যাথিড্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপর যেখানে আগে একটা জেলখানা ছিল, সেই জায়গা পছন্দ হল কার্জন সাহেবের। সৌধ তৈরির জন্য সেই জেলখানাকে সরিয়ে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হল আলিপুরে।

    সেটাই এখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেল নামে পরিচিত, যা আবার এখন স্বদেশি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। ৫৪ একর জমির উপর সেই সৌধ তৈরির কাজ শুরু হল। ১৯০৬-এর ৪ জানুয়ারি, রানির নাতি জর্জ প্রিন্স অফ ওয়েল্‌স, বা পরবর্তীকালের রাজা পঞ্চম জর্জ, কলকাতায় এসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেলেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের। স্যর উইলিয়ম এমারসনের নকশায় বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে সাদা মার্বেলের এই সৌধ তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় পনেরো বছর।

    খরচ হয়েছিল এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, যার সবটাই এসেছিল রাজা-মহারাজা ও সাধারণ মানুষের দেওয়া দান থেকে। মাটি থেকে ৮ ফুট উঁচু, ৩৯৬ ফুট লম্বা এবং ২২৮ ফুট চওড়া মূল সৌধের চারদিকে চারটে টাওয়ার। ভিতরের দুটো তলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর সাজানো হল বিভিন্ন শিল্পবস্তু দিয়ে। ১৯২১ সাধারণাব্দের ২৮ ডিসেম্বর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দ্বার উদ্ঘাটন করেন প্রিন্স ওফ ওয়েলস এডোয়ার্ড অ্যালবার্ট।

    (এই প্রবন্ধ সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। এর দায় কোনওভাবেই এই সময় ডিজিটাল বহন করে না)
  • Link to this news (এই সময়)