• নিখুঁত হাতে ভাজেন মালপো-জিলিপি, দেড়শো মেলা ঘুরে ফেলেছেন সুধাসিন্ধু
    বর্তমান | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • সুকান্ত বসু, কলকাতা: তাঁর হাতে তৈরি গজা নাকি অমৃতসমান। এমন তরিবত করে জিলিপি ভেজে রসে ভিজিয়ে দেবেন যে, গোটা চারেক না খেলে নাকি আশ মিটবে না। মেলায় মালপো খেতে তাঁর দোকানেই নাকি ঘুরে ঘুরে আসেন মানুষ। এই করতে করতে বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘোরা হয়ে গিয়েছে তাঁর। প্রায় দেড়শোটি মেলা ঘুরে ফেলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনও মহকুমা নেই যেখানে তিনি জাননি। এভাবে ভিয়েন বসাতে বসাতে ৬৩টি বছর পার করে ফেললেন বৃদ্ধ মানুষটি। বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকেন বলে ক্রমশ পর হয়ে যাচ্ছে নিজের ঘর। কতদিন যে আপন গ্রামে পা পড়েনি তা মনেও করতে পারেন না। লোকটার নাম সুধাসিন্ধু মণ্ডল। পেশায় মিষ্টি-শ্রমিক। স্টল মালিকদের কাছে ভাড়ায় খাটেন। গজা-নিমকি-জিলিপি-মালপো বানান। 

    সুধাসিন্ধুবাবুর বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন কোস্টাল এলাকার রামনগর গ্রামে। বাবা নদীর খাঁড়ি থেকে মাছের মীন সংগ্রহ করতেন। অভাবের সংসার। ফলে ছোটবেলায় পড়াশোনার সুযোগ বিশেষ হয়নি। বাঘের ভয় উপেক্ষা করে বাবার সঙ্গে মীন ধরতে খাঁড়িতে নামতেন শিশু বয়সে। বেলার দিকে অন্যের জমিতে জন খাটতে যেতেন। এভাবেই চলছিল। আচমকা তাঁর বাবা এবং মা দু’জনেই মারা যান। অভাব যায় আরও বেড়ে। পেটের তাগিদে গ্রামের এক মাতব্বরের হাত ধরে লেগে যান মালপো, জিলিপি, গজা তৈরির কাজে। মানুষটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল উত্তর শহরতলির বরানগরের এক মেলায়। 

    হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রথমে কিছুতেই জিলিপি তৈরি হতো না। এখন সবকটি জিলিপি আড়াই প্যাঁচের। ওজনের কোনও হেরফের হবে না। গ্রামবাংলায় আমার হাতের মালপো-জিলিপি খেয়ে প্রশংসা করেননি এমন হয়নি।’ খানিকটা আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, ‘এখন গোটা বাংলা আমার বাড়ি। আর আসল বাড়িটা গিয়েছে পর হয়ে। সেখানে এখনও অভাব, যন্ত্রণা। মন আরও খারাপ হয়ে যায়। পুজোয় সকলের নতুন জামা-কাপড় হয়। আমাদের পরিবারের কারও নতুন জামা হয় না। দু’বেলা ভাতই জোটে না ভালো করে। তারপর তো জামাকাপড়।’ সুধাসিন্ধুর একটি ছেলে। তিনি ছোট একটা কাজ করেন। ‘আমার এই দুর্দশার কথা চিন্তা করে ওকে আর এই পথে টেনে আনিনি। এই কাজে কোনও ভবিষ্যৎ নেই...’-মিষ্টি তৈরি করতে করতে বলতেই থাকেন সুধাসিন্ধু।

    রসের পাশে অষ্টপ্রহর থাকলেও পরিবারের ও নিজের জীবনটাকে মিষ্টি করতে পারেননি ৬৩ বছরের এই বৃদ্ধ। তিতকুটে অভাব তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম। পাহাড় থেকে নদী। জলে-জঙ্গলে ঘেরা তার গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে সন্ধ্যাবেলা গান হয় ‘দেখ ঐ সুধাসিন্ধু উছলিছে/ পূর্ণ ইন্দু পরকাশে/ভুতের বোঝা ফেলে/ ঘরের ছেলে আয় চলে আয় আমার পাশে...’ সুধাসিন্ধু মণ্ডলের কিছুতেই আর ফেরা হয় না। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)