• Durga Puja History : কলকাতার প্রথম যুগের তিন ‘বারোয়ারি’ দুর্গাপুজোর কথা, জানুন কাহিনি
    এই সময় | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • প্রাপ্ত তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর দাবি অনুসারে বলা হয়ে থাকে, বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৬০৬ সাধারণাব্দে, নদিয়ার জমিদার ভবানন্দ মজুমদারের ভদ্রাসনে। তার কয়েক বছর পরে, ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার তাঁর আটচালায় দেবী দুর্গার পুজো করেন। পলাশির যুদ্ধের পর কলকাতা ইংরেজদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় আশপাশের জেলাগুলিতেও তার ঢেউ লাগলো। আবার ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তোর কারণে গ্রামাঞ্চলেও এক শ্রেণির বিত্তশালী জমিদার গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটল। ওই নব্য জমিদার সম্প্রদায় বিত্ত দেখাতে সাধ্যমতো দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে আরম্ভ করলো।কিন্তু ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’। সব বাবুদের অবস্থাও সব সময়ে সমান থাকে না। হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া অঞ্চলের এমনই এক গৃহস্বামীর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় তাঁর বাড়ির বিন্ধ্যবাসিনী পুজো বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল। তখন আঞ্চলিক বারো জন যুবক নিজেরা চাঁদা তুলে পুজোটিকে রক্ষা করেন। বারো জন ‘ইয়ার’ বা বন্ধুর সংঘবদ্ধ প্রয়াসে তাই এটি চিহ্নিত হয় ‘বারোইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পুজো বলে। সময়কাল আনুমানিক ১৭৯০ সাধারণাব্দ।একক উদ্যোগের পুজো রূপান্তরিত হল একাধিক জনের পুজোতে। ধনীর অঙ্গন ছেড়ে পুজো নেমে এল পথে। সেই শুরু, কিন্তু গুপ্তিপাড়ার আদর্শ অনুসরণ করে মফস্‌সল-গ্রামাঞ্চলে এক-আধখানা সম্মিলিত উদ্যোগের বারোয়ারি পুজোর কথা শোনা গেলেও শহর কলকাতায় তার ঢেউ আসতে লেগে গেল আরও ১২০ বছর।দুর্গাপুজোকে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে নিয়ে আসার কৃতিত্ব দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দাদের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে আদিগঙ্গার তীরবর্তী বলরাম বসু ঘাট রোড অঞ্চলের কতিপয় যুবক ও ব্যবসায়ী একত্রে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোত্‌সাহিনী সভা’ নামে এক ধর্মীয় সংগঠন। প্রথম সভাপতি প্রিয়নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দুর্গাপুজো তখন উৎসবে রূপান্তরিত হয়ে উঠলেও তা প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল বিত্তবান পরিবারগুলির মধ্যে। তাই ওই সভার সদস্যেরা একত্রিত হয়ে ১৯১০ সালে আরম্ভ করলেন সম্মিলিত উদ্যোগের দুর্গাপুজো। শহর কলকাতার প্রথম ‘বারোয়ারি পুজো’। বাড়ির পুজো নামল রাস্তায়।‘বারোয়ারি পুজো’ কথাটির অর্থ হল বারো জন ইয়ারি বা বন্ধুর সম্মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত পুজো-অনুষ্ঠান। ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’-র সেই পুজো এখনও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন আর প্যান্ডেল বেঁধে পুজো হয় না। বলরাম বসু ঘাটের উপরে জোড়া শিবমন্দিরের পাশেই তৈরি করে নেওয়া হয়েছে পাকা মণ্ডপ। সূচনায় ছিল বারোয়ারি, অর্থাৎ অঞ্চলের কিছু মানুষ টাকা দিয়ে পুজোর আয়োজন করতেন। এখন তা রূপান্তরিত হয়েছে সর্বজনীন পুজোয়।ভবানীপুরে বারোয়ারি প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯১১ সালে আরও একটা বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হল উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে রামধন মিত্র লেনে। অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা যায়, সেখানকার কতিপয় ব্যক্তি শ্যামপুকুরে এই বারোয়ারি পুজোর পত্তন করেন। ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক তথা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি কিংবা আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি-আলেখ্য-খ্যাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মতো বিশিষ্ট জনেদের নামও জড়িয়ে আছে পুজোর সঙ্গে। এটাও আদিতে ছিল বারোয়ারি পুজো, বর্তমানে ‘শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ নামে পরিচিত।প্রায় কাছাকাছি সময়ে রামধন মিত্র লেনের পরেই। উত্তর কলকাতার সিকদারবাগান অঞ্চলে আরও একটা প্রাচীন বারোয়ারি পুজো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৩ সাধারণাব্দে। পল্লিবাসী মেয়েদের অন্যত্র পুজো দেখতে যাওয়ার অসুবিধার জন্য টাউন স্কুলের বিপরীত গলিতে অনুষ্ঠিত এই পুজোর সূচনা হয়।কলকাতায় বারোয়ারি দুর্গাপুজো প্রবর্তনের প্রথম যুগে যেহেতু বারোয়ারি পুজোমণ্ডপ বেশি ছিল না, তাই এই সব পুজোগুলির গুরুত্বও ছিল খুব বেশি।বিশ শতকের প্রথম দিক থেকেই বাড়ির পুজোগুলির রমরমা কমতে থাকে, পাশাপাশি বারোয়ারি পুজো আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই সূচনালগ্নে পুজোগুলি বারোয়ারি অর্থাৎ কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাধারণ মানুষের বহুল যোগদানের কারণেই পরবর্তী কালে এগুলো সর্বজনীন পুজোতে পরিণত হতে থাকে। এই পুজোও তার ব্যতিক্রম নয়।
  • Link to this news (এই সময়)