• Explained: অবস্থান বদল! দীর্ঘদিন প্যালেস্তাইনের পাশে থাকা ভারত কীভাবে ঢলে গেল ইজরায়েলের দিকে?
    ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস | ০৯ অক্টোবর ২০২৩
  • গাজা উপত্যকার শাসক, জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস অতি সম্প্রতি ইজরায়েলের ওপর সবচেয়ে সাহসী হামলা চালিয়েছে। যে হামলাকে ইতিমধ্যেই অনেকে ১৯৪৮ সালে সৃষ্টির পর ইহুদি রাষ্ট্রের ওপর সবচেয়ে ভয়ংকর হামলা বলে দাবি করেছেন। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই হামলাকে ‘জঙ্গি হামলা’র তকমা দিয়েছেন। তিনি এই হামলার ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। আর, হামলার কারণে ইজরায়েলের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। যদিও বিদেশ মন্ত্রক এখনও এই হামলা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি। বরং, বলা ভালো যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলোকেই ইজরায়েল যেন পুনরাবৃত্তি করেছে। সাধারণ নাগরিকদের নির্যাতন ও হত্যা করার ভয়ংকর দৃশ্য কিংবা পণবন্দি হিসেবে ইজরায়েলের নাগরিকদের বন্দি করার ঘটনা অনেককেই অবাক করেছে। আর এই কর্মকাণ্ডকে নয়াদিল্লি ক্ষমা করেনি। যা বুঝিয়ে দিয়েছে, ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গত সাত দশকে অনেকটাই বদলেছে।

    স্বাধীনতার পরের বছরগুলোয়

    ইজরায়েলের প্রতি ভারতের রাজনৈতিক মনোভাব ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পরই দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিল। সেই সময় জওহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধী প্যালেস্তাইনকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কারণ তাঁরা ধর্মের ভিত্তিতে দুটি জাতির ধারণা মানতে চাননি। যদিও তাঁদের ইহুদিদের প্রতিও সহানুভূতি ছিল। গান্ধী ও নেহরু, উভয়েরই ধারণা ছিল যে ধর্মীয় একচেটিয়াবাদের ভিত্তিতে কোনও রাষ্ট্র নৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে টিকতে পারে না। তাঁদের এই ধারণা, ভারত বিভাজনের বিরোধিতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্যালেস্তাইনের ব্যাপারে ভারতের অবস্থানও আরব বিশ্বের সাধারণ ঐকমত্য, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন এবং রাষ্ট্রসংঘের ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

    ভারতের স্বীকৃতি

    যখন প্যালেস্তাইন বিভাজনের প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রসংঘে ভোটাভুটি হয়, তখন আরব দেশগুলির সঙ্গে ভারতও বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। এমনকী, ইজরায়েল রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন জানালে ভারত বিপক্ষেই ভোট দিয়েছিল। নয়াদিল্লি অবশ্য ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, দুটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তুরস্ক-ইরানের স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এমনকী ১৯৫৩ সালে ইজরায়েলকে মুম্বইয়ে একটি কনস্যুলেট খোলার অনুমতিও দেওয়া হয়। কিন্তু, নয়াদিল্লি কোনও কূটনীতিকের উপস্থিতি মঞ্জুর করেনি। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে, প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ইয়াসির আরাফাতের অধীনে প্যালেস্তাইনের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই সময়, ভারত পিএলও, আল ফাতাহ-এর অধীনে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তোলে। ১৯৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি, ভারত পিএলও-কে প্যালেস্তাইনের জনগণের একমাত্র এবং বৈধ প্রতিনিধির স্বীকৃতি দেয়। একে নয়াদিল্লিতে একটি স্বাধীন অফিস তৈরির অনুমতি দেয়। ইজরায়েলকে ভারতের স্বীকৃতি ছিল শেষ অমুসলিম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটিকে দেওয়া স্বীকৃতি। আর, পিএলওকে দেওয়া স্বীকৃতি ছিল, প্রথম কোনও অ-আরব রাষ্ট্রকে দেওয়া ভারতের স্বীকৃতি।

    ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর জমানায়

    ১৯৮০ সালে, যখন ইন্দিরা গান্ধী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসেন, সেসময় প্যালেস্তাইনের সংগ্রামের প্রতি তিনি তাঁর সমর্থন অব্যাহত রাখেন। ভারত পিএলও অফিসকে সব কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা-সহ দূতাবাসের মর্যাদা দিয়েছিল। আরাফাত ৮০-র দশকের গোড়ার দিকে দিল্লিতে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। সেই সময় ভারত এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার হয়। ১৯৮৩ সালের মার্চে ভারতে জোট নিরপেক্ষ (NAM) রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল। সেসময় নয়াদিল্লি প্যালেস্তাইনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লিবিয়া সফরের পর তিউনিসে আরাফাতের সদর দফতর পরিদর্শন করেন। ছয় মাস পর যখন তাঁকে হত্যা করা হয়, তখন আরাফাত শ্মশানযাত্রায় অংশ নেন এবং জনসমক্ষে কেঁদেও ফেলেন। তারপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাজীব গান্ধীও প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি একইরকম রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইজরায়েলের ‘লোহার মুষ্টি’ নীতির কারণে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে প্যালেস্তাইনে ইন্তিফাদা (অভ্যুত্থান) শুরু হওয়ার সময়ও ভারত প্যালেস্তাইনের প্রতি তার সমর্থন বজায় রেখেছিল।

    তার মধ্যেই অবস্থান বদল

    এসবের মধ্যেও কিন্তু, ভারতের ইজরায়েল নীতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছিল। দেশের মধ্যে থেকেই নয়াদিল্লির প্যালেস্তাইন নীতি এবং ভারতের আরব বিশ্বের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থনের নীতির বিরোধিতা শুরু হয়। এর কারণ ছিল, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর নিরপেক্ষ অবস্থান এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি আরব দেশগুলোর পূর্ণ সমর্থন, ভালোভাবে নেয়নি হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আর, এই সময়ই ভারতকে সাহায্য করেছে ইজরায়েল। ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ইজরায়েল ভারতকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করেছে। তারই মধ্যে ১৯৯৯ সালের আগস্টে কুয়েতকে ইরাক আক্রমণ করলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। সাদ্দাম হোসেনের প্রতি সমর্থনের কারণে পিএলও নয়াদিল্লির দেওয়া তার রাজনৈতিক সুবিধা হারায়। সেই সময়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এই পরিস্থিতি ভারতকে তার পশ্চিম এশিয়া নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। এরপর ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারত সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তার আগেই অবশ্য তেল আবিবের (ইজরায়েল) সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ইজরায়েল। এই স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। আর, ইজরায়েলের প্রতি ভারতের আদর্শগত বৈরিতা হ্রাস করে।

    আরও পড়ুন-

    ইজরায়েলে হামলায় জড়িত! হিজবুল্লাহর নাম শুনেই কাঁপছেন অনেকে, কিন্তু, কেন?

    বিজেপির উত্থান, অবস্থান বদলের পিছনে

    ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে বিজেপির উত্থানও দেশের ইজরায়েল নীতি পরিবর্তনে বড় ভূমিকা পালন করে। ১৯৯২ সালের ১৯-২০ জানুয়ারি, প্যালেস্তাইনের প্রেসিডেন্ট আরাফাত ভারতে একটি সরকারি সফর করেন। প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সময়, আরাফাতকে বলা হয়েছিল যে ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্যালেস্তাইনের জন্য সহায়ক হবে। নয়াদিল্লি, আরাফাতকে বলেছিল তেল আবিবে ভারতের রাষ্ট্রদূত থাকলেই প্যালেস্তাইন ইজরায়েলের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রাওয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কথোপকথনের পরে, আরাফাত নয়াদিল্লিতে তাঁর প্রেস কনফারেন্স করেছিলেন। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রদূতদের বিনিময় এবং স্বীকৃতি (ইজরায়েলের) সার্বভৌমত্বের কাজ, সেখানে আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না… আমি ভারত সরকারের যে কোনও পছন্দকেই সম্মান করি।’

    সামরিক সম্পর্ক এবং কার্গিল যুদ্ধ

    ১৯৯৯ সালে কারগিল সংঘাতের সময় ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছিল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর উন্নত বোমার প্রয়োজন ছিল। কারণ, পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীরা কার্গিলের পাহাড়ের ওপরে গুহা এবং বাংকারে লুকিয়ে ছিল। ভারতীয় বায়ুসেনা ইজরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ইজরায়েল সময় নষ্ট না-করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের জরুরি এবং মজুত অস্ত্র ভারতে পাঠায়। যা, প্রয়োজনের সময় যুদ্ধে নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করে। এর পরে, বাজপেয়ী সরকার ২০০০ সালে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরের সময় বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংকে ইজরায়েলে পাঠায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদবানিও ২০০০ সালের গ্রীষ্মে ইজরায়েল সফর করেন। দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর ভারত-ইজরায়েল সম্পর্ক আরও মধুর হয়। ২০১৭ সালে মোদী তাঁর ইজরায়েল সফরের সময় প্যালেস্তাইন সফর করেননি। যা অতীতে ভাবাই যেত না। মোদী সরকার অবশ্য এই সফরের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ছিল। সাউথ ব্লক নিশ্চিত করেছে যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ইজরায়েল সফরের আগে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সৌদি আরব, ইরান, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ ইজরায়েলের সমস্ত আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রে সফর করেছেন। নয়াদিল্লি অবশ্য, ২০১৭ সালের মে মাসে প্যালেস্তাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে আতিথ্য দিয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায়, সাউথ ব্লকের কর্তারা প্যালেস্তাইনের প্রতি ভারতের সমর্থন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন।
  • Link to this news (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)