• ‘ভয় করছে, সরকার উদ্ধার করবে কবে’
    আনন্দবাজার | ১০ অক্টোবর ২০২৩
  • সকালে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ। এক হাতে চা-বিস্কুট, অন্য হাতে ল্যাপটপ, পকেটে পাসপোর্ট, সব নিয়ে ছুটলাম শেল্টার রুমের দিকে। সরকার থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, সাইরেন বাজলে দেড় মিনিটের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে শেল্টার রুমে। আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই রকেট ফাটল। প্রকাণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। ডর্মেটরির জানলা দিয়ে দেখলাম, দূরের আকাশে আগুনের গোলা।

    আমার বাড়ি সুভাষগ্রামে। বছর দুয়েক হল এ দেশে রয়েছি। তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি। সাইরেনের আওয়াজ আগেও শুনেছি আমি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। মনে সদর্থক ভাবনা রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভয় লাগছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ভারতীয় পড়ুয়া রয়েছেন। বাঙালির সংখ্যাও অনেক। আমার ল্যাবেই অনেক ভারতীয় কাজ করেন। সবাই যতটা সম্ভব এক সঙ্গে থাকছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক পড়ুয়ারা মিলে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলেছি। সেখানে একে অন্যের খোঁজ রাখছি। বিদেশি পড়ুয়াদের সাহায্যের জন্য একটি ট্রমা কেয়ার অনলাইন পোর্টাল খোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভয় লাগলে সেখানে জানালে কেউ না কেউ সাহায্য করছেন। বিদেশি পড়ুয়াদের অনেকেই ইজ়রায়েল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। ইজ়রায়েলি যাঁরা ছাত্রাবাসে থাকতেন, তাঁরা বাড়ি চলে গিয়েছেন। অনেক পড়ুয়া আবার দেশের হয়ে লড়ার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।

    ভারতীয় দূতাবাস থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সবাই চাই, আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হোক। শুনলাম অভিনেত্রী নুসরত বারুচাকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছে সরকার। আমাদেরও নিয়ে যাক। তেল আভিভবিমানবন্দরে হামলা চলেছে। এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানও বন্ধ। নিজেরা তো একা একা দেশে ফিরতে পারব না।

    আমার এক পরিচিত ইজ়রায়েলি যুবক রনের মুখে শুনলাম, ওঁর বাবার বন্ধুর ছেলে খুন হয়েছে হামাসের হাতে। এক জনকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল ওরা। ছেলেটি বাধা দিতে গিয়েছিল। তাতে মেরে ফেলা হয় ওঁকে। একেবারে বাচ্চা ছেলে, কুড়ির আশপাশে বয়স। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। বহু বিদেশিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে হামাস। এক জন নেপালিকে অপহরণ করার খবর পেয়েছি। আমাদের বারবার করে বলা হয়েছে নিজেদের ঘরে থাকতে। বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ। তবু বলা তো যায় না। ডর্মেটরির নীচেই বাজার-দোকান রয়েছে। কাল সকালে সবাই মিলে গিয়ে ওখান থেকে বাজার করে এনেছি। কোথায় যেন শুনলাম জল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই জলও কিনে রেখেছি।

    স্থানীয় ইজ়রায়েলিরা আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘‘ভয় পেও না। আমরা তোমাদের পাশে আছি।’’ শুধু মুখে বলা নয়, ইমেল করে আমাকে এক জন বলেছে, ‘‘দেশে ফিরতে হবে না। আমরা তোমাদের রক্ষা করব।’’ শুনে একটু শান্তি লাগছে। এখানে যাঁদের সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে, তাঁদের অনেকেই দেশের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হয়ে লড়তে যাচ্ছেন। প্রবাসী ইজ়রায়েলিদের অনেকে ঘরে ফিরছেন বিপদে দেশের পাশে থাকার জন্য। বিপদের সময়ে যাতে যোগাযোগে কোনও সমস্যা না হয়, তার জন্য ইন্টারনেট ডেটা ও ফোনের নেটওয়ার্ক বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।

    মনে জোর রাখার চেষ্টা করছি। তবে ভয় তো করছেই। ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি আমি। সরকার থেকে বললেই যাতে দেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তে পারি।

    (লেখক তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক)

  • Link to this news (আনন্দবাজার)