সফল মঞ্চ-ব্যবহার ও একজন দিনোকৃষ্ণ তন্ময় ভট্টাচার্য একজন মানুষ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা করতে ব্যবহার করছেন ধর্মীয় মঞ্চকেই। সবাই যেখানে শুনতে এসেছে তত্ত্বকথা, কৃষ্ণনাম; মানুষটি মাইকের সামনে একাদশী পালনের বিরোধিতায় সোচ্চার। বলছেন সারাদিন উপোস থাকার পর সন্ধেয় ময়দা খাওয়ার অপকারিতা। কোলেস্টেরল বৃদ্ধি, হার্ট ব্লকেজের সম্ভাবনা। অতএব, উপবাসের পর যদৃচ্ছা ভোজন নৈব নৈব চ! মঞ্চ-ব্যবহারের এমন উদাহরণ সচরাচর দেখা যায় না। আমরা যে-কোনো ক্ষেত্রেই সাধারণত মঞ্চোপযোগী বক্তব্য শুনতেই অভ্যস্ত। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদেরও আগাম ধারণা থাকে, কোন বিষয়ে কথাবার্তা এগোবে। সেখানে আলোচ্য ব্যক্তি, দিনোকৃষ্ণ ঠাকুর, নির্ভীক কণ্ঠে বলছেন—'যারা বলে সংস্কৃত না-বললে নাকি ঠাকুর খায় না, আমি বলি ওরম ঠাকুর পূজা করার দরকার নেই। আমি ভাই বাঙালি, কোনো সংস্কৃতভাষী মানুষ না।' শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল রঞ্জিত দাসের কথা।চন্দ্রকোণার এক গ্রামে তাঁর পূর্বপুরুষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন 'সন্ন্যাসীঠাকুর' নামে এক দেবতার। থান আছে একটা, তবে পূর্বাপর কিছুই জানা যায় না। কোন মন্ত্রে পূজা হয় জিজ্ঞেস করতে রঞ্জিত বলেছিলেন—"আমরা তো অত মন্ত্র জানি না দাদা! ওই 'ভালো থেকো, সবাইকে ভালো রেখো'— এটুকুই মনে-মনে বলি ঠাকুরকে।" কিংবা কালাকড়ি গ্রামে শোনা ধর্মঠাকুরের ধ্যানমন্ত্র—বাংলাতেই। অনাদিকাল থেকেই নিজেদের দেবতার জন্য নিজের ভাষায় মন্ত্র তৈরি করে নিয়েছে বাঙালি। যে-উদাহরণ লুকিয়ে অজস্র ব্রত-পার্বণেও। জনপ্রিয়তা দেখে, সেইসব মন্ত্র ও পূজাবিধিতে পড়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের থাবা। লৌকিক দেবতাদের 'গ্রাস' করে 'মূলস্রোত'-এ অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা। টিকে-থাকা বাংলা মন্ত্রগুলি প্রতিস্পর্ধার জানান দেয়। অব্রাহ্মণ পূজারীদের উদাহরণ জানায়, দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য ব্রাহ্মণ হওয়া জরুরি নয়। সমান্তরালভাবে বহমান এই ধারারই উত্তরাধিকারী দিনোকৃষ্ণ, যিনি কীর্তন ও কৃষ্ণকথার আসরে বুক ঠুকে বলে ওঠেন—'আমি বাঙালি'।উচ্চারণ-অনুসারে 'দিনোকৃষ্ণ'ই লেখা অধিকাংশ জায়গায়। আসল বানান কি দীনকৃষ্ণ? এসব চিন্তা ছেড়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে মন দিই। সম্প্রতি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগরে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। কারণ, একটি সভায় কৃষ্ণ-কে 'অসুর' বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী ও যযাতি-র সন্তান যদু; যিনি কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ। যা ঊহ্য রেখেছেন—শুক্রাচার্য ব্রাহ্মণ হয়েও নারায়ণ-বিরোধী ও অসুরদের অস্ত্রশিক্ষা দিতেন, ফলে তিনিও 'অসুর' অর্থাৎ সুর(দেব)-বিরোধী। এ-তত্ত্ব নিঃসন্দেহে প্রবল তর্কসাপেক্ষ; শুক্রাচার্য যদি 'অসুর' হনও, তার দায় আদৌ উত্তরাধিকারীদের ওপর বর্তায় কিনা, তা-ও বিবেচ্য। কিন্তু এসব ভাবনাচিন্তা ও আলোচনার সময় নেই কারোর। কৃষ্ণকে 'অসুর' বলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে হিন্দুত্ববাদীদের রোষ আছড়ে পড়েছে তাঁর ওপর। তাড়া করেছে ভিড়। ভিড় থেকে ছিটকে এসেছে 'জয় শ্রীরাম'-ধ্বনিও। কৃষ্ণকে নিয়ে এই মন্তব্য ফুলকি হিসেবে কাজ করলেও, দিনোকৃষ্ণের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের ক্রোধ যে ধিকিধিকি বাড়ছিলই, তার প্রমাণ আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে তৈরি অসংখ্য প্রতিহিংসামূলক ভিডিয়ো।কিন্তু এই রাগের কারণ কী? পদবি 'ঠাকুর' হলেও জাতিগতভাবে তিনি নমঃশূদ্র, মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অক্লেশে বলেন—'ব্রাহ্মণ কে? যে মন্ত্র জানে সে ব্রাহ্মণ? না যে মন্ত্র জানে না, ব্রহ্মকে জানে—সে ব্রাহ্মণ? যে অনেক মন্ত্র জানে, সে ব্রাহ্মণ নয়। যে এক ব্রহ্মকে জানে—সে-ই ব্রাহ্মণ।' জানান, পূজা মন্ত্রের প্রতি নির্ভরশীল নয়, পূজার মূল উপকরণ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। দিনোকৃষ্ণের বলা কথাগুলি নতুন কিছু নয়। বাংলায় ভক্তিবাদের প্রাবল্য এসেছিল চৈতন্যের হাত ধরে। তারপর পাঁচশো বছর ধরে বিভিন্ন শাখা জারিত হয়েছে ভক্তিরসে। দিনোকৃষ্ণও সেই ধারারই উত্তরসূরি। কিন্তু যে-দেশে সংসদ ভবনের উদ্বোধনে আমন্ত্রিত হন তাবড় ব্রাহ্মণেরা, সে-দেশে দিনোকৃষ্ণের এমন বক্তব্যে বিশাল সংখ্যক মানুষের গাত্রদাহ হওয়াই স্বাভাবিক। তবে বক্তব্যের থেকেও বড়ো হয়ে ওঠে বলার ক্ষেত্রটি। বাংলার গ্রাম-মফস্সলের সন্ধেগুলি এমন কীর্তন ও কথকতার আসরে বুঁদ হয়ে থাকে ঐতিহ্যগতভাবেই।কীর্তনিয়ারা গান শোনান, সেইসঙ্গে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেন ধর্মতত্ত্ব। বলা বাহুল্য, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার প্রচারিত হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। সাম্প্রতিক অতীতে এই জাতীয় কথকতার আসরে এক অকালপক্ক কিশোরীর কুসংস্কারাচ্ছন বক্তব্য হয়তো শুনেছেন অনেকেই। এইসব আসরে শ্রোতার অভাব হয় না কোনোদিন। কথকদের থেকে রসদ সংগ্রহ করেন তাঁরা, যা অবচেতনে প্রবেশ করে জীবনযাপনেও। এমন একটি ক্ষেত্রকেই ব্যবহার করতে চেয়েছেন দিনোকৃষ্ণ। চেয়েছেন, লোকে আসবে ধর্মকথা শুনতে, কিন্তু নিয়ে ফিরবে 'সত্য'। তিনি জানেন, আলাদা করে এসব বক্তব্য প্রচার করলে, গুরুত্ব দেবে না কেউই। কিন্তু আমন্ত্রিত একজন কীর্তনিয়া হিসেবে পেশ করলে, লোকে গুরুত্ব দিয়ে শুনবে। তালিম-নেওয়া সংগীতজ্ঞ তিনি, পাশাপাশি মনোযোগী পড়ুয়াও। যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণের গুণটি আয়ত্ত করেছেন, তারপর প্রবেশ করেছেন সেই পেশার জগতে, যেখানে মানুষকে 'প্রভাবিত' করা অপেক্ষাকৃত সহজ। গ্রামীণ মজলিসে 'কাছের মানুষ' হয়ে বলে চলেন সেইসব কথা, যা শ্রোতাদের আজন্মলালিত ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষার বিপ্রতীপে অবস্থান করে। রীতি অনুযায়ী, 'হরি হরি' ধ্বনিতেই সাধারণত এই জাতীয় আসর শুরু ও শেষ হয়ে থাকে। মনে পড়ে যায় পাঁচশো বছর আগের এক 'পাগল'-এর কথা, যিনি বলেছিলেন 'হরের্নামৈব কেবলম্'—শুধুমাত্র হরির নাম নিলেই তরে যাবে মানবজাতি। হরিনামকে অস্ত্র করেই সমাজে জাতপাতের ভেদ ঘোচাতে চেয়েছিলেন সেই 'পাগল'।সেই হরিধ্বনি উচ্চারিত হয় দিনোকৃষ্ণের মুখেও। কিন্তু তিনি জানেন, বহুব্যবহারে সে-নামও 'ভোঁতা' হয়ে গেছে। একুশ শতকের এই ধর্মান্ধতার যুগে, সরাসরি শ্রোতার স্নায়ুতে আঘাত দিতে চান তাই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ধর্ম ও বিজ্ঞানের বৈপরীত্য, শেষে সওয়াল করেন বিজ্ঞানের হয়েই। প্রচারের সুবাদে সর্বগ্রাসী ব্রাহ্মণ্যবাদের যে রমরমা বাংলা তথা ভারতে, তার বিরুদ্ধেই লড়াই দিনোকৃষ্ণের। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলেন, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের কাহিনিতে দেবতারা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রাজাদের পরীক্ষা নিতে যেতেন; কাওরা, মুচি বা মেথরের ছদ্মবেশে যেতেন না কেন? জবাব দেন নিজেই—'ব্রাহ্মণ জাতিকে বড়ো করার জন্যে।' এমনকি, সরাসরি আঘাত হানেন অনেকের আঁতে— 'যে মাছ খাচ্ছে তাকে মন্দিরে উঠতে দিচ্ছে না, যে মাংস খাচ্ছে তাকে গোপালের গায়ে হাত দিতে দিচ্ছে না, যারা মাছ-মাংসখেকো মানুষ (তাদের) ঠাকুরঘরে পর্যন্ত বসা নিষিদ্ধ, তাহলে তোমরা ভাই জবাব দিতে পারবে, তোমাদের ঠাকুরঘরে গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি করা খোলটা কী করছে?' ফলে, তাঁকে হজম করা খানিক শক্তই। দিনোকৃষ্ণ যা-যা বলেন, যে-সমস্ত রেফারেন্স তুলে আনেন, সবই যে নির্ভুল, সে-দাবি করা যায় না। কথার তোড়ে যুক্তিও শিথিল হয়ে যায় কখনো-সখনো। তবে এই খামতিটুকু দিয়ে তাঁর বিচার করা অনুচিত। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তিনি একজন মুক্তচিন্তক; ধর্মের মঞ্চকে ব্যবহার করে ধর্মান্ধতায় আঘাত হানতে সিদ্ধহস্ত। একে সামাজিক অবস্থানজনিত রাজনীতিও বলা যেতে পারে। যাই হোক-না কেন, অচলায়তনে অস্বস্তি জাগাতে পেরেছেন ইতিমধ্যেই। এমন মানুষের প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের আক্রোশ সহজে ফুরনোর নয়। ভবিষ্যৎ তাঁকে নিরাপত্তা দিক...