জঙ্গল না থাকলে বাঘ থাকবে না, বাঘ না থাকলে জঙ্গলও মুছে যাবে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগে এই কথায় বাঘকে পাণ্ডবদের সঙ্গে আর জঙ্গলকে কৌরবদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এর অর্থ, কোনও একটি না থাকলে অন্যটি থাকবে না।
দেশের অন্যতম ‘ডেকরেটেড’ জঙ্গল, করবেট টাইগার রিজ়ার্ভে ঘটে যাওয়া বড়সড় দুর্নীতির একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে পৌরাণিক মহাকাব্যের এই কথাই মনে করালেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। একই সঙ্গে উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন বনমন্ত্রী হড়ক সিং রাওয়াত এবং ডিএফও কিষান চাঁদকে বিঁধে তাঁদের বক্তব্য, রাজনীতিবিদ এবং বনাধিকারিকদের যোগসাজশে কী ভাবে করবেটের মতো বিখ্যাত জঙ্গলে আইনকে পায়ের তলায় রেখে দুর্নীতি চলতে পারে, তার ‘ক্ল্যাসিক্যাল’ উদাহরণ এই ঘটনা।
যত দ্রুত সম্ভব একটি হাই লেভেল কমিটি গড়ে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিআর গভাই, বিচারপতি প্রশান্তকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ। এই ঘটনায় সিবিআইকেও তিন মাসের মধ্যে স্টেটাস রিপোর্ট দিতে বলেছে শীর্ষ আদালত।
ঠিক কী ঘটেছে?
২০২১ সালের অগস্টে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দাখিল করেন আইনজীবী গৌরবকুমার বনসল। ফোনে ‘এই সময়’কে গৌরব বলেন, ‘আমি জানাই, করবেট টাইগার রিজ়ার্ভের পাখরাউ জ়োনে রাজ্য বন দপ্তর একটি ‘জ়ু’ তৈরি করছে যেখানে চিড়িয়াখানার খাঁচাবন্দি জন্তুদের এনে ‘টাইগার সাফারি’-তে তাদের ‘ডিসপ্লে’ হবে। এই কাজ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী এবং এর জন্য বিপুল সরকারি টাকা খরচ করে পরের পর বেআইনি নির্মাণ হয়েছে করবেটের কোর এরিয়ায়। কোনও নিয়ম ও অনুমতির তোয়াক্কা না করে কেটে ফেলা হয়েছে প্রায় ৬০০০ গাছ!’
প্রায় একই অভিযোগে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গত বছর সুয়োমোটো মামলায় ঘটনার তদন্তভার তুলে দেয় সিবিআইয়ের হাতে। দু’টি মামলার উল্লেখ করেই এদিন রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তদন্তে দেখা গিয়েছে, করবেটের পাখরাউ জ়োনের ১৬ হেক্টর এলাকায় জঙ্গল সাফারির জন্য রাস্তা বানানোর নাম করে ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের কাছে ১৬৩টি গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছিল উত্তরাখণ্ড সরকার।
অথচ অভিযোগ ওঠে, এর থেকে অনেক বেশি গাছ কাটা হয়েছে। বেআইনি নির্মাণও হয়েছে টাইগার রিজ়ার্ভের কোর এরিয়ায়। আলাদা করে এই ঘটনার তদন্ত শুরু করে বন মন্ত্রক এবং ন্যাশনাল টাইগার কনজ়ারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ)। তদন্তে যুক্ত হয় ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টও। সব মিলিয়ে দেখা যায়, গাছ কাটার সংখ্যাটা সত্যিই ৬ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ নির্দিষ্ট করা ১৬ হেক্টরে সরকারি ভাবে গাছই আছে ৩ হাজারের কিছু বেশি। তাতে স্পষ্ট হয়, অনুমতি ছাড়া শুধু বেশি গাছ কাটা হয়নি, ‘টাইগার সাফারি’র নাম করে বেশি এলাকাও নেওয়া হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘রাজনীতিবিদ এবং আমলারা মানুষের বিশ্বাস ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। আমরা এদের স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ট্যুরিজ়মকে সামনে রেখে রাজনৈতিক এবং আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে সব নিয়মনীতি উড়িয়ে দিয়েছেন এঁরা।’ এই পরিস্থিতিতে দেশে বাঘের জঙ্গল বাঁচাতে সুপারিশের জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়েছিল। যদিও সুপারিশে বেশ কিছু পরস্পর-বিরোধিতা আছে।
ফলে সুপ্রিম কোর্ট বন মন্ত্রককে বেশ কয়েক জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে কমিটি গড়তে নির্দেশ দিয়েছে সুসংহত সুপারিশের জন্যে। পিটিশনার গৌরবের কথায়, ‘এই রায় ঐতিহাসিক। এটুকু স্পষ্ট হলো, জঙ্গলের ভিতরে দুর্নীতি করে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে পার পাওয়া যায় না।’