গ্রামীণ চিকিৎসক (কোয়াক) ও গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের মেডিক্যাল সায়েন্স সম্পর্কে ধারণা গড়ে তুলতে প্রত্যন্ত গ্রামে ‘চিকিৎসা জাদুঘর’। নিজের জন্মস্থান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালের জয়নগর গ্রামে এই মিউজ়িয়াম গড়েছেন কলকাতার বিশিষ্ট গায়নেকোলজিস্ট ড. বিমানচন্দ্র ঘোষ।
সেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ডাক্তারিতে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম, শরীরের নানা অঙ্গের মডেল, নরকঙ্কাল ইত্যাদি। আল্ট্রা সোনোগ্রাফি বা কোলোনোস্কপিতে কী করা হয়, কী কী তথ্য জানা যেতে পারে এই টেস্টগুলি করলে, গলব্লাডার স্টোন আসলে কী, তার টেস্ট কী করে করা হয়, অপারেশনই বা হয় কী করে - এ সব কিছুই জানা যাবে এই সংগ্রহশালায় এলে।কোন রোগের কী উপসর্গ সে তথ্যও জানা যাবে জাদুঘরে। এছাড়াও এখানে স্থান পেয়েছে প্রখ্যাত চিকিৎসকের ছবি ও লেখা। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে এই সংগ্রহশালা কেন? আসলে গ্রামের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই অসুস্থ হলে প্রথমেই ছুটে যান কোয়াকদের কাছে। যেখানে চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, সেই সমস্ত এলাকায় অসুস্থদের অন্যতম ভরসাস্থল এই কোয়াকরাই।
তাই নানা মেডিক্যাল কনডিশন নিয়ে তাঁদের প্রাথমিক ধারণাটুকু থাকলে, উপকৃত হবেন গ্রামের মানুষেরাই। জটিল রোগের ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্তত রোগীর পরিজনদের ঠিকভাবে গাইড করতে পারবেন। এর পরে কোন পথে চিকিৎসা চালাতে হবে, কোন ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে - সে সব পরামর্শও তাঁদের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা। ‘চিকিৎসা সংগ্রহশালা’ তাঁদের এই ধারণা তৈরি করে দিতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসক বিমানচন্দ্র ঘোষ।
কোয়াকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন ফার্মাকোলজির চিকিৎসক স্বপন জানা। এই চিকিৎসা সংগ্রহশালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামাঞ্চলে যে কোয়াকরা রয়েছেন, যাঁরা পাশ করা চিকিৎসক নন, তাঁরা এ রকম চিকিৎসা সংগ্রহশালা দেখা, খানিক পড়াশোনার সুযোগ পেলে, নিজেদের যোগ্যতা-দক্ষতাকে আরও পরের ধাপে নিয়ে যেতে পারবেন।’
কোয়াক-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা লিভার রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের দীর্ঘ দিন ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। আমাদের কাজটিকে ২০১৬ থেকে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর অধিগ্রহণ করেছে।’ ‘চিকিৎসা সংগ্রহশালা’ সেই প্রশিক্ষণে সাহায্যই করবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
ঘাটালের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মে ষাটের দশকে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান ড. ঘোষ। শহরে গায়নেকোলজিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করার পরে মাঝেমাঝে গ্রামের বাড়িতে আসতেন ছুটিতে। সেই সময়েও তাঁর কাছে ভিড় করতেন বহু মহিলা রোগী। শেষপর্যন্ত রোগীর সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে, প্রতি মাসে রোগী দেখতে নিয়ম করে ঘাটালে আসতে হতো তাঁকে।
রোগী তো দেখতেনই, সেই সঙ্গে আসতেন বহু গ্রামীণ চিকিৎসক। সেখান থেকেই নতুন ধরনের একটা ভাবনা মাথায় আসে তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি, অনেক গ্রামীণ চিকিৎসক অনেক কিছু জানেন। এত দিন ধরে কাজ করতে গিয়ে পর্যবেক্ষণের ফলে জেনেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের বিজ্ঞানসম্মত ধারণাটা নেই। তাই ভেবেছিলাম যদি গ্রামে চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি তথ্য, যন্ত্রপাতি, ছবি, লেখা ইত্যাদি সংগ্রহ করে একটা সংগ্রহশালা গড়ে তোলা যায়! আস্তে আস্তে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। বিভিন্ন চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নানা সাহায্য পেয়েছি। অবশেষে ঘাটালে গ্রামের বাড়িতে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে পেরেছি।’
সম্প্রতি এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া, যিনি নিজেও চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘রাজ্য তো বটেই সারা দেশে বেসরকারি উদ্যোগে এমন চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রদর্শনী আর নেই বলেই মনে হয়।’ ড. ঘোষ বলেন, ‘আপাতত সপ্তাহে ৩ দিন খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানুষ আসুন, দেখে কিছু জ্ঞান অর্জন করুন, এটাই আমার উদ্দেশ্য। স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারাও আগে থেকে যোগাযোগ করে আসতে পারেন।’