• কোনও প্রশ্ন নয়..., ভোটের মুখে বেড়ি? ইমার্জেন্সি মেন্টেন্যান্সে 'ডাউন' RTI পোর্টাল
    এই সময় | ০৯ মার্চ ২০২৪
  • এই সময়: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করে 'দ্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া' (এসবিআই) ইলেক্টোরাল বন্ডের যাবতীয় হিসেব ও তথ্য ৬ মার্চের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দেয়নি, সময় চেয়েছে অন্তত ৩০ জুন অবধি! এর পরেই কংগ্রেস ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি, এসবিআইকে ব্যবহার করে বিজেপি বিষয়টাকে ভোটের পরে নিয়ে যেতে চাইছে। এটা আসলে তথ্য গোপন করারই প্রয়াস। কংগ্রেসের সাফ কথা, এই তথ্য সামনে এলে বিজেপি বিপদে পড়ে যাবে। প্রকাশ্যে এসে যাবে তারা কী ভাবে বন্ডের বিনিময়ে তাদের পছন্দের সংস্থাগুলোকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। এর পরেই সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ। তার শুনানি ১১ মার্চ।কেন্দ্রীয় সরকারের 'তথ্য গোপন'-এর এই 'কৌশল' নিয়ে যখন চূড়ান্ত বিতর্ক রাজনৈতিক মহলে, তখনই সামনে এসেছে আর একটি বিস্ফোরক তথ্য - 'ইমার্জেন্সি মেন্টেন্যান্স'-এর জন্য 'ডাউন' কেন্দ্রীয় সরকারের আরটিআই পোর্টাল! ৪ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহের বেশ ক'দিন সেখানে তাই কিছুই করা যায়নি, বিশেষ করে ইতিমধ্যেই ফাইল হওয়া আরটিআইগুলির বর্তমান স্টেটাস কী, তা সহজে অ্যাকসেস করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি, জাতীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) -এর ওয়েবসাইটও 'কাজ করছিল না।' সেটা অবশ্য আপাতত ঠিক করা হয়েছে। কমিশনের আরটিআই সংক্রান্ত বিষয় তারা নিজেরাই এই সাইটের মাধ্যমে মেন্টেন করে। এই জোড়া 'ইমার্জেন্সি' নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ-ই মুখ খোলেননি। কমিশনও কোনও বিবৃতি দেয়নি। তবে Indian Computer Emergency Response Team (CERT-in) -এর সূত্রে খবর, কমিশনের ওয়েবসাইটে কিছু ডেটা ব্রিচ হয়েছিল। সেটা তাদের নজরে আনেন করণ সাইনি নামে একজন টেক এক্সপার্ট। তার পরেই CERT-in যোগাযোগ করে কমিশনের সঙ্গে। দেখা যায়, যাঁরা আরটিআই আবেদন করেছেন, সে রকম অনেকেরই ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে! এটা 'ব্যক্তি নিরাপত্তায় বিরাট গলদ' মেনে নিয়ে তা ঠিক করেন টেকনিক্যাল এক্সপার্টরা। CERT-in এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই সমস্যা জানার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন সব ঠিক আছে।

    তবে শুধু ব্যক্তিগত পরিচয় ফাঁসই কমিশনের ওয়েবসাইটের একমাত্র 'সমস্যা' ছিল না। অনলাইন পেমেন্টও সব ক্ষেত্রে করা যাচ্ছিল না। এখন যদিও পেমেন্ট করা যাচ্ছে, তবে তা করা যাচ্ছে শুধুমাত্র ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বা নেটব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে। একটি নির্দিষ্ট পেমেন্ট গেটওয়ে কাজ করছে না। অথচ সেটি সব রকম 'ডিজিটাল পেমেন্ট অপশন' দিচ্ছে অন্য সব সাইটেই। তা হলে কমিশনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন? উত্তর মেলেনি। আবার নেটব্যাঙ্কিং-এর অপশন থাকলেও সেখানে এসবিআই নেই! প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি আরটিআই-অ্যাকটিভিস্টরা যাতে সহজতম উপায়ে ইউপিআই পে বা ওয়ালেট পে করতে না পারেন, তথ্য জানার জন্য তাঁদের একটু 'কষ্ট' করতে হোক, তাই-ই চাইছে ইসি?

    আর কেন্দ্রীয় সরকারের আরটিআই পোর্টালে লগ-ইন করে নতুন আবেদন জমা দেওয়া যাচ্ছে কিন্তু আগের করা কোনও আরটিআই-এর তথ্য বা স্টেটাস কিছুই দেখতে পারছেন না আবেদনকারীরা। পুরোনো আবেদন বা আবেদনের স্টেটাস দেখার জন্য আবেদনকারীকে ফাইলিং নম্বর ম্যানুয়ালি দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে তার পরেই আসছে 'এরর' মেসেজ যেখানে বলা হচ্ছে ওই সাইটে 'ইমার্জেন্সি মেন্টেন্যান্স'-এর কাজ হচ্ছে, সে জন্য 'কয়েক মিনিট' সময় লাগবে। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে এই স্টেটাসের কোনও হেরফের হচ্ছে না।

    কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ 'ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিং' (DoPT) এই আরটিআই পোর্টালের দায়িত্বে। তাদের এই 'জরুরি মেন্টেন্যান্স' নিয়ে একটি সংবাদপত্র প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু কোনও জবাব মেলেনি। সংশ্লিষ্ট পোর্টালের একজন সাপোর্ট এজেন্ট তাঁর পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, তাঁদের এই Ongoing downtime নিয়ে কোনও ধারণাই নেই। দপ্তরের তরফে কিছুই বলা হয়নি। তবে তাঁর ধারণা, ১৫ দিনের আগে এই টেকনিক্যাল সমস্যা ঠিক করা কঠিন। এক জন পাবলিক ইনফর্মেশন অফিসার (PIO) অবশ্য জানিয়েছেন, সরকারি কর্তা-ব্যক্তিরা সব রকম অ্যাকসেসই করতে পারছেন, এমনকী অ্যাপ্লিকেশন প্রসেস করতেও কোনও সমস্যা হচ্ছে না!

    এর পরেই শুরু হয়েছে জোর গুঞ্জন। লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হতে আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। শুক্রবার ইসিআই-এর ফুল বেঞ্চ মিটিং করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে। ঠিক তার আগেই 'সমস্যা' তথ্যের অধিকার জানার ক্ষেত্রে আর তা কবে ঠিক হবে তা নিশ্চিত ভাবে কেউ জানাচ্ছেনও না। তা হলে কি বিষয়টা শুধুই 'টেকনিক্যাল' নয়, তার সঙ্গে অন্য সমীকরণও আছে? কমিশনের সাইটের আরটিআই সেকশনের আর ডিওপিটি-র আরটিআই পোর্টালের একসঙ্গে 'ইমার্জেন্সি মেন্টেন্যান্স' কি শুধুই কাকতালীয়?

    ওয়াকিবহাল মহলের একটা বড় অংশ মনে করছেন, লোকসভা নির্বাচনের আগে যাতে কোনও অপ্রীতিকর বা অস্বস্তিকর তথ্য প্রকাশ না পায় বা এমন কোনও পরিসংখ্যান সামনে না আসে যা নিয়ে বিরোধী শিবির চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারে - সে জন্যই বোধহয় 'জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ' একটা বিরাট ইস্যু হয়ে উঠেছে। আর কবে ঠিক হবে যখন স্পষ্ট নয়, তখন তো এ কথা বলা যেতেই পারে পুরোনো আরটিআই-ও যাতে অ্যাকসেস করতে না পারেন সাধারণ মানুষ, সে জন্যই এমন ব্যবস্থা!

    এক র‍াজনৈতিক বিশ্লেষক 'এই সময়'কে বলেন, 'বিষয়গুলি লক্ষ্য করে দেখুন। প্রথমে নির্বাচনী বন্ডের তথ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও এসবিআই নির্দিষ্ট দিনে কমিশনকে জমা করল না। ইসিআই-এর ওয়েবসাইটে আরটিআই অ্যাক্টিভিস্টদের ব্যক্তিগত তথ্যফাঁস ও সর্বোপরি কেন্দ্রের আরটিআই পোর্টালের 'সিলেকটিভ ফাংশনিং' - সবটাই তো কেমন যেন ধারাবাহিক মনে হচ্ছে।' এক আরটিআই কর্মীর মতে, 'দেশের তথ্য-অধিকার কর্মীরা যাতে বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ান, তাঁদের হেনস্থা করা হয় - ইসিআই পোর্টালে তথ্য-ফাঁস তারই সুদক্ষ প্রচেষ্টা! তবে এ ভাবে কোনও তথ্যকর্মীকে ভয় দেখানো যায় না। সত্যকে চাপা রাখা যায় না।'

    ২০১৩ সালে এই পোর্টাল চালু হওয়ার পরে ২০২২ পর্যন্ত ৫৮ লক্ষের একটু বেশি আরটিআই এর মাধ্যমে ফাইল হয়েছে ও জবাব মিলেছে। কিন্তু গত বছর অগস্টে কয়েক জন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট দেখেন যে ২০২২-এর আগের শয়ে শয়ে তথ্য ওই সাইট থেকে মিসিং! তার মধ্যে একজন অ্যাক্টিভিস্টের শুরুর দিন থেকে ২০২১ পর্যন্ত যাবতীয় তথ্য উধাও! একটি সংবাদপত্রে এই নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট বেরোলে ডিওপিটি সেই সব তথ্য ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তবে তাদের বার্তা ছিল, আরটিআই পোর্টাল যাতে দ্রুত কাজ করে, তাই আর্কাইভ শুরু করা হলো!' কিন্তু ডেটা কী ভাবে উড়ে গিয়েছিল, তার ব্যাখ্যা এখনও অজানাই।

    গত বছর থেকে RTI Online portal-এ আর নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করার সুযোগ সরিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। যুক্তি, ওয়েবসাইটের উপর 'প্রবল চাপ।' আর যাঁদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাঁরা তা চালু রাখতে চাইলে ৬ মাসে অন্তত ১টা আরটিআই ফাইল করা বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে তা রিকভারির জন্য 'ফরগট পাসওয়ার্ড' অপশনও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! মধ্যপ্রদেশের এক আরটিআই-কর্মীর প্রশ্ন, 'তথ্যকে এত ভয় সরকারের! পিএম কেয়ার্স তো এর আওতার বাইরে। তা হলে কী চাপতে চাইছে সরকার, কেন এত রকমের ফন্দি?' তাঁরা মানতে নারাজ সবই টেকনিক্যাল ইস্যু।

    তা হলে কি ৩৭০-এর টার্গেট পেরোতে রামলালার 'আশীর্বাদ' যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটা ঠিক পাচ্ছে না বিজেপি - প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে।
  • Link to this news (এই সময়)