• ‘ধাঙড়-রানি’... ঠাট্টা? না, প্রভাবতী-সাকিনার লড়াইয়ের স্বীকৃতি!
    এই সময় | ১০ মার্চ ২০২৪
  • সায়ন্তনী সেনগুপ্ত১৮৫৭-র ৮ মার্চ। নারী টেক্সটাইল শ্রমিকরা মিছিল করলেন নিউ ইয়র্কের রাস্তায়। দাবি, কাজের সময় কমাতে হবে, পুরুষদের মতোই সমকাজে সম মজুরি দিতে হবে। অনেক পরে, ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো, বহু সময়েই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বলা হয়েছে, ‘শ্রমজীবী’ শব্দটি নেই।

    তাই দিনটি এলেই বারবার মনে করাতে হয়, দিনটা আসলে শ্রমজীবী নারীদের স্মরণে, তাঁদের অধিকারের দািবতে। ইউএস-এর ঘটনাগুলির আঁচ তখন এসে পৌঁছয়নি ভারতে। অথচ সেই সময়েই, ধাঙড় আন্দোলনের নেতৃত্বে দুই নারী— সাকিনা বেগম, প্রভাবতী দেবী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই অন্ত্যজ ধাঙড় এবং জমাদার শ্রেণি পড়েছিল সঙ্কটে। তাঁদের হয়ে দাঁড়ালেন তাঁরা।

    শুধু ধাঙড় ইউনিয়ন নয়, চটকলের শ্রমিক ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রভাবতী দাশগুপ্ত। ১৯২৮ এর চটকল ধর্মঘটে তিনি ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। সেই সময়ে কলকাতা পুরসভায় ১০ থেকে ১২ হাজার ধাঙড় কাজ করতেন। তাঁদের মাইনে বাড়ানোর দাবিকে সংগঠিত করতে প্রভাবতীর নেতৃত্বে তৈরি হল’ দ্য স্কাভেনঞ্জারস ইউনয়ন অফ বেঙ্গল’। তাঁদের নিয়ে প্রথম বড় সভা হল ১৯২৮-এর ২৯ জানুয়ারি, মনুমেন্টের নীচে।

    ১৯২৮ এর ৪ মার্চ ধাঙড়রা ধর্মঘটে গেলেন। রাস্তায় স্তুপীকৃত জঞ্জাল জমা হতে লাগল। ধর্মঘট কিছুতেই ভাঙতে না পেরে ব্যাপক পুলিশি ধরপাকড় শুরু করল প্রশাসন। ১৯২৮ এর ২৪ জুন দ্বিতীয়বার ধর্মঘটে গেলেন মেথর-ঝাড়ুদাররা। পরের দিন তিনি ও মুজফ্ফর আহমেদ হাজরা পার্কে সভা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন।

    প্রভাবতী দাশগুপ্তের ঠিক এক দশক পরে আর এক নারী এগিয়ে আসেন ধাঙড়দের নেতৃত্ব দিতে। তিনি বেগম সাকিনা ফারুক সুলতানা। তিনি অচ্ছুৎ ঝাড়ুদার মেথরদের দাবি নিয়ে সরব হলেন তিনি। ভোটে দাঁড়িয়ে সাকিনা পুরসভার নির্দল কাউন্সিলর হিসাবে লড়ে জিতলেন তিনি। সাকিনার নেতৃত্বে ১০ হাজার শ্রমিককে নিয়ে তৈরি হল শ্রমিক ইউনয়ন। সাকিনার বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল ধাঙড়দের ইউনিয়ন অফিস। তাঁকে বলা হত, ‘ধাঙড় রানি’।

    বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় এর পরের ধর্মঘট যখন শুরু হল, তখন অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা হয় পলাতক নয়ত অন্তরীণ। মেথর, জামাদার বস্তিগুলিতে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পুলিশ, গুলি চালায়। দ্বিতীয় দিনে সাকিনা-সহ ১০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলন শুরু হওয়ার ১৫ দিন পর শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়।

    পরে সাকিনাকে মুক্তি দেওয়া হলেও মেয়র তাঁকে কলকাতা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এরপর শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে আর কোনও যোগ রাখেননি সাকিনা। প্রভাবতী, সাকিনা— কারওরই চলার পথ মসৃণ ছিল না। একে তো দলিতদের আন্দোলন, তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই নারী! রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’তে প্রভাবতীর ধূমপানের অভ্যাস থেকে জার্মানিতে পড়তে যাওয়া নিয়ে বক্রোক্তি করা হয়।

    ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকে। সাকিনার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে চলে কাঁটাছেড়া। সমীক্ষা বলছে, এখনও কর্মক্ষেত্রে, সমাজে নারীদেরকে স্টিরিওটাইপের মোকাবিলা করতে হয় প্রবলভাবে। তাই প্রভাবতীদের সময়ের এক শতক পরেও এত প্রতিবন্ধকতা। নারী দিবসে যেন না ভুলি, আমরা এই নেত্রীদের উত্তরসূরী!
  • Link to this news (এই সময়)