ছিছিক্কার পড়ে গিয়েছে নেট দুনিয়ায়। এ কী ধরনের অসভ্যতা? শেষে রোবটের বিরুদ্ধেও কি না উঠল #মিটু অভিযোগ! হোক না রোবট, তাকে শেখাচ্ছে তো মানুষই। সৌদি আরব বলেই কি…? যেখানে নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে অনেক সময়েই।ঘটনাটা কী, বলা যাক আগে। সৌদি আরবের রিয়াধে ডিপফেস্ট নামে একটি ফেস্ট বা মেলা চলছিল। যে মেলার উদ্দেশ্য, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে সৌদি আরব কতটা এগিয়ে গিয়েছে, তা বিশ্বকে জানানো। দিন পাঁচেক আগে সেই মেলায় প্রথমবারের জন্য সামনে আসে ‘মুহাম্মদ’।
সৌদি আরবে তৈরি এক পুরুষ রোবট। যে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, ‘আমি মুহাম্মদ, পুরুষ রূপে প্রথম সৌদি রোবট। সৌদি আরবে একটি জাতীয় প্রজেক্টে আমাকে তৈরি করা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি প্রদর্শনের জন্য।’ এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। বিপত্তি হল, এক মেয়ে সাংবাদিক মুহাম্মদের ইন্টারভিউ করতে এগিয়ে যাওয়ার পরে।
সাংবাদিকটি তার কাছে পৌঁছে ক্যামেরার দিকে ফিরে দাঁড়ান। তারপরেই একটি হাত তুলে মেয়েটির প্রতি ‘ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট টাচ’ করে ওই রোবট। মেয়েটি চমকে একটি হাত তুলে বারণ করার মতো ভঙ্গি করেন, যেমনটা হয়তো কোনও মানুষ থাকলেও করতেন। এই ভিডিয়ো ক্লিপটি এর পরেই ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আর এখনকার দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় বিচারসভা তো সোশ্যাল মিডিয়াই। তাই শুরু হয়ে যায় এই ভিডিয়োটি নিয়ে কাটাছেঁড়া। প্রশ্ন ওঠে, রোবট কী করে একজন মহিলাকে ‘হেনস্থা’ করে? রোবটের ‘অশালীন আচরণ’-এর তুমুল নিন্দা চলতে থাকে। কেউ লেখেন, ‘এ রকম প্রোগ্রামিং কে লিখল?’ কারও মন্তব্য, ‘পারভার্ট রোবট’।
এখন প্রশ্ন, সত্যিই কি রোবটের ‘ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট টাচ’-টি ইচ্ছা করেই ছিল? নাকি কোনও ভাবে ‘ম্যালফাংশন’ করে ছিল? রোবটটির প্রস্তুতকারক সংস্থা কিউএসএস এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি এখনও। তাই সঠিক ভাবে জানা সম্ভব নয়। তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে অভিজ্ঞ কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ার বিচারসভাতেই মন্তব্য করেছেন।
কারও মত, সম্ভবত কেউ সামনে এলে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত তোলার প্রোগ্রামিং ছিল রোবটে, সেই উদ্দেশ্যেই হাত তুলতে গিয়েছিল মুহাম্মদ। কেউ দাবি করেছেন, হাত তোলাটা নেহাতই ম্যালফাংশনিং। এর সঙ্গে হ্যারাসমেন্টের কোনও অভিসন্ধি খুঁজতে যাওয়ার মানে হয় না।
এখন প্রশ্ন, রোবট কি সত্যিই যৌন হেনস্থার পথ বেছে নিতে পারে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটা লার্নিং প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যায়। এই সিস্টেমের নির্মাণকারী তাকে কতটা শেখাচ্ছে, কী কী কাজ করার জন্য ট্রেনিং দিচ্ছে, তার উপরেই নির্ভর করে তার শিক্ষা। ল্যাঙ্গোয়েজ লার্নিং মডেল যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি ইত্যাদি এআই মডেলগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় নিরন্তর শিক্ষার বিষয়টি।
তিন মাস আগে করা কোনও প্রশ্নের যে উত্তর সে দিয়েছিল, তিন মাস পরে তার আপডেটেড উত্তর মেলে। অর্থাৎ, নতুন কিছু সে শিখে নিয়েছে ওই সময়ের মধ্যে। কিন্তু সদ্য তৈরি হওয়া রোবট, যাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করা হয়েছে প্রদর্শনীর জন্য, তাকে কি হেনস্থার পাঠ দেওয়া হবে? এ যুক্তি মানতে চাইছেন না অনেকে।
এমনকী, এত অল্প সময়ের মধ্যে ‘হেনস্থা’ কী করে করা যায়, তা নিজে নিজে এই রোবটের জন্য নির্ধারিত এআই শিখে ফেলবে, এটাও মনে করছেন না অনেকে। তাই ম্যালফাংশনিংয়ের দিকেই আঙুল উঠছে। আর এক দল নেটিজ়েন মনে করছেন, দোষটা কিছু মানুষের অতিরিক্ত ‘ওক’ (woke) হয়ে ওঠায়।
তাঁদের দাবি, সামাজিক ইস্যুগুলি নিয়ে জ্ঞাত থাকা অবশ্যই দরকার। কিন্তু অনেকাংশেই তা বাড়াবাড়ির আকার নিচ্ছে। যেমনটা হয়েছে সৌদি আরবের এই রোবটের ক্ষেত্রে। ম্যালফাংশনিং বরং রোবটের ক্ষেত্রে একটি ‘কমন’ ঘটনা। ছোটখাটো থেকে বড়— সব রকম উদাহরণই আছে।
গত বছর নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটনাটি বেশ মর্মান্তিক। কারখানায় ভেজিটেবল বক্স মনে করে এক কর্মীকে তুলে কনভেয়ার বেল্টের উপরে আছাড় মেরে রাখে এক রোবট। তড়িঘড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। বছর কয়েক আগে ক্যালিফোর্নিয়ার এক শপিং মলে রোবট সিকিউরিটি গার্ড ধাক্কা দিয়েছিল এক শিশুকে। চিনে এক কনফারেন্সে প্রদর্শনীর জন্য রাখা এক রোবট হঠাৎই দড়াম করে কাচ ভেঙে ফেলে।
এমন নজিরের সংখ্যা কম নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভুল করে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে এ রকম ঘটনাও ঘটেছে। অর্থাৎ, একটি বিষয় এই সব ঘটনায় পরিষ্কার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে প্রয়োজন আছে, তা অনেকেই বুঝতে পারছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা রোবট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার দরকারও আছে। না হলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
চ্যাটজিপিটি বা অন্য এআই ল্যাঙ্গোয়েজ মডেল নিয়ন্ত্রণের দাবিও উঠেছে। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ কী ভাবে কোন পর্যায়ে আনা সম্ভব, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পথের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। ডিপফেস্ট চলাকালীন মুহাম্মদের ভঙ্গি এ রকমই কোনও ম্যালফাংশনিং কি না, তা নিশ্চিত ভাবে জানাতে পারে একমাত্র কিউএসএস সংস্থাই। ততক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচার চলুক!