ছ’বছর ধরে বরের সঙ্গে বাইকে চেপে বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন যে নারী, ভারতবর্ষেও প্রায় কুড়ি হাজার কিলোমিটার ভ্রমণের পর ঝাড়খণ্ডের দুমকা গ্রামের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে রাত্রিবেলা তাঁবু খাটিয়ে স্বামীর সঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বছর আঠাশের সেই স্প্যানিশ যুবতী, যিনি তখনও জানেন না এই প্রকৃতির বুকে সাত-আট জনের হাতে গণধর্ষিতা হতে হবে তাঁকে।ভ্রমণ মানুষকে কত দূর সহনশীল করে জানি না, কিন্তু গণধর্ষণের পরেও, ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেও তিনি বলতে পেরেছেন যে, এই দেশের উপর তাঁর কোনও রাগ নেই, ভারতবর্ষ তাঁকে আহত করেনি, আহত করেছে ধর্ষকরা। বাইকে চেপে বিহার হয়ে নেপাল চলে যাচ্ছেন ওঁরা, আমরা দেখছি, পড়ছি, কিন্তু ভাবছি কি? আমরা, ভারতবাসীরা?
আমরা কি মনে মনে জানি না, এই ভারতের বুকেই কখনও উন্নাও, কখনও হাথরাস, কখনও সন্দেশখালি, কখনও মণিপুর, কখনও দুমকা আমাদের বারবার জানিয়ে দিয়ে গেছে, সভ্যতার অগ্রগতি যত দূরই হোক না কেন, সেই আদিম যুগের মতোই গোষ্ঠী হোক, জাতি হোক, ধর্ম হোক, রাজনীতি হোক, প্রতিটি কোন্দলে আজও ধর্ষিতা হয় নারী শরীর? কোথায় গলদ থেকে যাচ্ছে?
মানসিকতার কোন আঙিনায় এত দূর অন্ধকার? এক দিকে বলা হচ্ছে মেয়েদের বাঁচাতে হবে, দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হচ্ছে ‘বেটি বাচাও’, কিন্তু কী বলা হচ্ছে আসলে? কেন বাঁচাতে হবে মেয়েদের? যাতে তারা বাবা দাদা কাকাদের গরম গোল রুটি করে দিতে পারে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ মনে পড়ে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। সতেরো বছরের একটি মেয়ের ঘাড়ে দেবীত্বের বোঝা চাপিয়ে কী ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল জীবনের স্বাভাবিকতা। ধূপধুনোর ওই পুজোর আড়ালে শ্বাসরোধ করা একাকীত্ব, দেবী হয়ে ওঠার খেসারত। মেয়েদের স্বাভাবিক মানুষ ভাবতে আজও সমাজ অপারগ, হয় মেয়েরা দেবীর মতো দশভুজা, অতিমানব, না হয় তারা মানুষের পর্যায়েও পড়ে না।
হয় এক দিকে সতীদাহ প্রথা, বিধবার একাদশী, না হয় আর এক দিকে নারীকে পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুর সম্পদ ভেবে লকারে তুলে রাখা। তাই পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ বাধলে, একে অন্যের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে চাইলে প্রথম ছিনিয়ে নেওয়া হয় নারীকে। নারী শরীরকে। যেন সে তার নিজের নয়, চিরকাল অন্য কারও। হয় পুরুষের, না হয় পরিবারের, না হয় রাষ্ট্রের।
সেই মহাভারতের সময় থেকে যে ভাবে ভীষ্ম লুঠ করে এনেছিল অম্বা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে তাঁর ভাই বিচিত্রবীর্যর জন্য। মনে রাখতে হবে, কোথা থেকে লুন্ঠিতা হয়েছিলেন এই নারীরা। তাঁদের স্বয়ংবর সভা থেকে। মেয়েদের এই ‘স্ব’কে পছন্দ করেনি কেউই, না ভারত, না মহাভারত। আর তাই এই ‘স্ব’টুকু বাঁচিয়ে রাখার লড়াই প্রতিনিয়ত। চিরকালীন।
দুমকার ঘটনাটা যখন ঘটছে, তখন ক্যালেন্ডার বলছে ১ মার্চ। যার ঠিক সাত দিন পর বিশ্ব জুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহাসিক ভাবে, আন্দোলনের নিরিখে এই নারী দিবসের তাৎপর্য বিপুল। পুঁজিবাদ এসে সেই তাৎপর্যকে দখল করে নিতে চাইলেও ইতিহাস জানান দেয়, হিরের মজুরিতে ছাড়, ব্র্যান্ডেড ব্যাগের উপর ছাড়, এই সব পেরিয়ে পূর্ব নারীদের ভোটাধিকারের লড়াই।
মনে পড়ে, ১৮৫৭-র নিউ ইয়র্ক শহরে তাঁতি মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে যথাযথ পরিবেশ, কাজের সময়সীমা, ন্যায্য আয়ের লড়াইয়ে মিছিল, মনে পড়ে নিউ ইয়র্কের সেনেকা ফলসের কনভেনশনের কথা, যেখান থেকে মেয়েদের ভোটাধিকারের লড়াই শুরু। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষেও এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যান সরোজিনী নাইড়ু, অ্যানি বেসান্তরা। কিন্তু তার পর? মেয়েরা ভোট দিল, নাগরিক হল, অথচ ধর্ষণ কমল না। শরীরকে পেরিয়ে কিছুতেই মানুষ হয়ে ওঠা হল না মেয়েদের।
এ কথা ভাবতে গেলেই মনে হয় ভাষার কথা। পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় খিস্তি তৈরি হয় মেয়েদের যৌনতার উপর ভিত্তি করে। পুরুষে পুরুষে লড়াই হলে একে অন্যকে আঘাত করার জন্য যে শব্দের ব্যবহার হয়, তা আসলে আঘাত করে মা, মাসি, বোন কিংবা স্ত্রীর যৌনতাকে। ভাষার কাছে এই দাসত্ব স্বীকার করে আমরা কি আটকে যাচ্ছি সভ্যতার ব্যাকসিটে?
নারী দিবসের প্রাক্কালে তাই লিঙ্গ-নির্বিশেষে মনে হয় মেয়েরা মানুষের মর্যাদা পেলে একটু ভার লাঘব হবে পুরুষেরও। রেগে যাওয়ার ভার, হিংসা ঘটানোর ভার, অত্যাচারের ভার, রক্ষণ-ভক্ষণের ভার, না কাঁদার ভার। কিন্তু এই ভাষায় কি আটকে থাকল কেবল পুরুষই? মেয়েরাও তো আয়ত্ত করে ফেলল এই একই ভাষা। ভেবে ফেলল ‘খিস্তি’ই সভ্যতার আধুনিকতার ফ্রন্টসিটে বসার প্রধান চাবিকাঠি।
মুশকিল হল এখানেই। নিজেদের যৌনতাকে আঘাত করে যে ভাষা, নিজেরাই তা বার বার ব্যবহার করে চললাম আমরা, বাঁচিয়ে রাখলাম ধর্ষণের বীজ আমাদেরই ভাষায়। অথচ এই নারী আন্দোলনের কত আগে, নয়ের শতকে চিন দেশে …