• মিসেস তমুক, কেয়ার অফ মিস্টার অমুক
    এই সময় | ১০ মার্চ ২০২৪
  • শতাব্দী দাস

    প্রণয়-প্রত্যাশার প্রথম পংক্তিটি যদি হয় ‘ভালো-বেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো— তোমার/ মনের মন্দিরে’, তবে পরের পংক্তিটি হল, ‘আমার পরানে যে গান বাজিছে/ তাহার তালটি শিখো— তোমার/ চরণমঞ্জীরে।’ সহজ চাওয়া! প্রথমে প্রেমাস্পদের নামখানিকে আপন করতে হবে। পরের লাইনে উদ্দেশ্যটি স্পষ্টতর: প্রেমিকার নৃত্যের তালে উচ্চারিত হয় যেন প্রেমিকের প্রাণের সুর।পুরুষের গীত আর নারীর নৃত্য মিলেমিশে সংগীত হবে। কিন্তু নতুন নাম, নতুন সুর আত্মস্থ করার দায়টি একা নারীরই৷ উচ্চবর্ণের পুরুষের ক্ষেত্রে ‘উপনয়ন’ যেমন ছিল নবজন্মের রূপক, তেমন নারীর ক্ষেত্রে রূপকার্থে এবং বাস্তবেও বিবাহই যেন নবজন্ম। না হলে কেন বদলাবে গোত্র? বা পদবি? এক কালে ‘পিতৃদত্ত’ (‘মাতৃদত্ত’ বলার চল ছিল না) নামটিও মুছে ফেলার চল ছিল।

    কবিপত্নীর ‘মৃণালীনী’ নামখানি কবিপ্রদত্ত। কিন্তু অমন কাব্যিক নাম সকলের জুটত না। কেউ হতেন ‘বড় বউ’। কেউ ‘খোকার মা’। কেউ আবার ‘মিসেস অমুক’। কেয়া চক্রবর্তী নিজের বৈবাহিক অস্তিত্বতে ঘিরে যে ব্যাঙ্গাত্মক এলোপাথাড়ি লেখা লিখেছিলেন, তার নামই ‘মিসেস আর পি সেনগুপ্ত’।

    স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে ওঠার পরেও সুচিত্রা সেন বা অপর্ণা সেনরা বৈবাহিক পদবি ঝেড়ে ফেলেননি, কারণ তত দিনে তা এতখানিই হয়েছে আত্মপরিচয়ের অঙ্গ। বিবাহের পর মেয়েমানুষের পূর্বাশ্রমের পদবি ছেঁটে ফেলার এই ধারাবাহিকতায় কেউ যদি বাধ সাধেন, কেউ যদি পদবি ছেঁটে ফেলতে না চান, তা হলে? তখন শ্বশুরবাড়ি বোঝান, আহা, নেমপ্লেটখানা যে বিসদৃশ দেখাবে!

    বড় হরফে ‘ব্যানার্জিজ়’, ‘মুখার্জিজ়’ বা ‘মন্ডল্‌স’ হিসেবে সকলকে দেগে দিলে, চোখের আরাম। সকল মঞ্জীর এক তালে বাজলেই না সাংসারিক সিম্ফনি! ২০২২ সালে থেকে ইন্টারনেটে ঘাপটি মেরে থেকে (ইন্টারনেট আর্কাইভ বলছে, ২০২২ সালের মে মাস থেকে এটি আন্তর্জালে আছে)— সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে— নারীর পরিচয় বিলোপ সংক্রান্ত এক সরকারি নির্দেশ।

    সরকারি নির্দেশ হলেও তাতে নেই তারিখ বা সিলমোহর। ‘আবাসন ও নাগরিক কার্যাবলি’ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের প্যাডে নোটিসটি দেওয়া হয়েছিল। এই মন্ত্রক আদৌ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী নয়। তা হলে কি এই বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল শুধু ওই মন্ত্রকের অধীনে নিযুক্তদের জন্য? তা-ও স্পষ্ট নয়।

    গোল বাধল, যখন দিব্যা নামের এক মেয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলেন। বিয়ের পর গ্রহণ করা বৈবাহিক পদবিটি তিনি বর্জন করতে চেয়েছেন বিচ্ছেদ মামলা চলাকালীন। পূর্বোক্ত ওই সরকারি নোটিসে তিনি বাধা পেয়েছেন। নোটিসে লেখা, বিবাহিত মহিলা যদি নিজের পদবি ব্যবহার করতে চান বরেরটি বিসর্জন দিয়ে, তবে লাগবে বরের লিখিত ‘নো অবজেকশন’।

    অন্যথায়, বিচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার কাগজ দেখালেও চলবে। কিন্তু দিব্যার যে বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়নি! একই ভাবে ‘নো অবজেকশন’ চাওয়া হত এক কালে— নারী একা বিদেশযাত্রা করতে চাইলে বা অঙ্গদান করতে চাইলে। এখন সে সব অতীত৷ কিন্তু সমাজমানসে তার চিহ্ন রয়ে গেছে। বছর বছর আশাপ্রদ বিজ্ঞপ্তি আসে। কখনও বলা হয়, পাসপোর্টে মায়ের নামই যথেষ্ট।

    কখনও বলা হয়, পূর্ণবয়স্ক নারীর পাসপোর্টে যে পদবি তাঁর পছন্দ, তা রাখবেন তিনি। এ অধিকার নাকি প্রাপ্য সংবিধানের বাক্‌স্বাধীনতার ধারা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও স্বাধীন জীবনযাপনের ধারা অনুযায়ী। কিন্তু সমাজমানসের পরিবর্তন হয় না বলে উল্টো মর্মের বিজ্ঞপ্তি, হুমকি বা চোখ মটকানোও কিছুতেই থামে না।

    এ ক্ষেত্রে বিচ্ছেদকালে সমস্যা দেখা গেছে। কিন্তু নারী যদি বিবাহে সুখী হন, তা সত্ত্বেও পদবি বদল না চান? এক সরকারি শিক্ষিকাকে বলা হয়েছিল, আগের পদবি ব্যবহারে তাঁর ‘স্বামী’র যে অসুবিধে নেই, এ কথা লিখে দিতে। কোন নিয়মে তিনি তা লিখে দিতে বাধ্য, তা জিজ্ঞাসা করায় বিষয়টি থমকায়। আর এক সরকারি চাকুরে মেয়ের অভিজ্ঞতা হল, কাজে যোগ দেওয়ার সময়ে যখন তাঁর ও তাঁর বরের পদবি মেলে না, তখন সন্দেহ করা হয়, ওঁদের সম্পর্ক ঠিক আছে তো?

    বিশেষত কর্মরত মেয়েরা এ হেন সমস্যায় প্রায় পড়ছেন৷ নানা খুঁটিনাটি নথিতে পদবি পাল্টানোর অনর্থক আইনি হ্যাপা কেউ কেন নেবেন? কেন এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিবাহ-পরবর্তী কাজ? কোনও মেয়ে একাধিক বিয়ে ক্রমান্বয়ে করলে, কতবার পদবি বদলাবে সে? নাকি, একের বেশি বিয়ের কথাখানি ভদ্রমণ্ডলীতে তোলাই পাপ? এই প্রশ্নগুলিও ওঠে।

    এরও পরে কথা রয়ে যায়। ছোটবেলার পদবিটি ঘিরে থাকতে পারে ভালো-লাগা, নস্ট্যালজিয়া, একাত্মতা। কিন্তু ভুললে চলে না, সে পদবিও বাবার থেকে পাওয়া। পিতাও কি চাননি, তাঁর সুরে নারীর স্বর বাঁধতে? কোনও কোনও মেয়ের ক্ষেত্রে (সবার ক্ষেত্রে নয়) সেই বাঁধনে হয়তো পতিগৃহের চেয়ে খানিক বেশি স্নেহের প্রলেপ। তবু তা স্বাধীনতা নয়।

    এক নারী একবার বলেছিলেন, বরের পদবি তিনি বেছেছেন, তাঁর চয়েস তা। কারণ বাপের চেয়ে বর কম ছড়ি ঘোরান তাঁর উপর। পদবি রাখতে হলে তাঁকে কোনও না কোনও পুরুষেরই পদবি নিতে হত যে! আর যদি মাতৃনামধারী হতাম? যদি জবালার ছেলে সত্যকামের মতো ‘জাবাল’ হতে চাইতাম? তবে কি মায়ের বিবাহপূর্ব পদবি নিতে হত?

    কিন্তু সেও যে মায়ের বাপের থেকেই পাওয়া, তাঁর মায়ের থেকে নয়! কোথায় খুঁজব তবে সুদূর সেই প্র প্র প্র তস্য প্রমাতামহীদের শিকড়? পদবি নাকি শিকড়ের সন্ধান দেয়! কী অসামান্য দক্ষতায় তা নিশ্চিহ্ন করা গেছে!
  • Link to this news (এই সময়)