Health Care Tips : আ হান্ড্রেড মাইলস... জীবনে এখন ওয়াকিংও ট্রেন্ড
এই সময় | ১১ মার্চ ২০২৪
এই সময়: গন্তব্য নাটোর না হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু হাঁটো ভাই হাঁটোরে। সুস্থ থাকতে চান যাঁরা, হাঁটা এখন তাঁদের রোজনামচায় সবচেয়ে বড় ‘ইন থিং’। অনেকেই নিছক পথচারী হিসেবে হাঁটতে ভালোবাসেন। তাঁদের কথা হচ্ছে না। হচ্ছে তাঁদের কথা, যাঁদের রুটিনে একেবারে মোটা হরফে লেখা থাকে ওয়াকিং।
যেমন তনুময় হাজরা। নববর্ষের ৩ তারিখ যেন ধড়ে প্রাণ পেলেন তিনি। মান্থলি সেলস ক্লোজ়িং, বর্ষশেষ আর বর্ষবরণের পার্টি করতে গিয়ে পরের দিন সকালে বাদ পড়ে গিয়েছে তাঁর রোজনামচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। ৩ জানুয়ারির সকালে স্মার্ট ওয়াচ মিলিয়ে পাক্কা অন্তত ৩০০০ স্টেপস হাঁটার পর মনটা জুড়িয়ে গেল বছর তেতাল্লিশের সেলস এগজ়িকিউটিভের। এ যে তাঁর গত সাত বছরের অভ্যাস!
সকালে উঠে দাঁত মাজার মতোই তার পর ঘড়ি ধরে ৪০ মিনিট হাঁটাকে গত সাড়ে তিন বছরে রুটিন বানিয়ে ফেলেছেন পেশায় আইনজীবী কল্যাণ রায়। এর কোনও দিন ব্যতিক্রম হলে দিনভর মেজাজটাই খিঁচড়ে থাকে। কোর্টের সেরেস্তায় পৌঁছেও মনে হয়, কোথায় যেন ছন্দপতন হচ্ছে কাজে! স্কুলশিক্ষিকা বন্দনা দত্তের আবার শুধু মেজাজটাই নয়, শরীরটাও যেন বিগড়ে রয়েছে মনে হয়, যে দিন সকালে তাঁর তিন কিলোমিটার হাঁটা না হয়। যত রাতই হোক শুতে, পরের দিন হাঁটার সময় বের করবেনই তিনি স্কুল বেরোনোর আগে।
এই তিন জন কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নন। সকালে, বিকেলে বা সন্ধেয় নিয়ম করে হাঁটা এখন বঙ্গজীবনের অঙ্গ। বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্বদের মধ্যে। ফলে মাঠে, ময়দানে, পার্কে বা সুন্দর রাস্তা আজকাল আর সাতসকালে ফাঁকা থাকে না। ভরে ওঠে স্নিকার্স পরা পথচারীতে। কেউ ওজন ঝরাতে হাঁটেন, কেউ হাঁটেন ফ্যাটি লিভার বা প্রেশার-সুগার-কোলেস্টেরলের মোকাবিলায়। কেউ নিছক ঘাম ঝরান নিজেকে তন্দরুস্ত রাখতে। আর জেন-জ়েড? তাদের অনেকেরই জিমে ট্রেড মিলে হাঁটা চাই-ই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের দৈনিক হাঁটা রাজনীতির বাইরেও দাগ কাটে জনমানসে। তবে শুধু আপনভোলা হয়ে অবশ্য হাঁটা না-পসন্দ অনেকেরই। বস্তুত, সিংহভাগেরই। বরং দৈনিক কতটা হাঁটা হচ্ছে, তাতে কত ক্যালরি বার্ন হচ্ছে, কত স্টেপ হেঁটে হার্ট বিট কত থাকছে, সে সব তথ্যই কব্জির ডিভাইসে মজুত করা এবং নিয়মিত তার পর্যালোচনা করাও মানুষের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। সে জন্যই গত কয়েক বছরে স্মার্ট ওয়াচের বিক্রিও বেড়ে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিক্রেতারা।রাধাবাজারের ঘড়ি বিক্রেতা অমরিন্দর সিং বলছেন, ‘গত তিন বছরে তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে স্মার্ট ওয়াচের বিক্রি। সেটা শুধু ফ্যাশনের কারণে নয়, শরীরচর্চার তাগিদেও।’ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাসের কথায়, ‘টানা জোরে হাঁটলে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে বিটা-এন্ডরফিন নামে একটি প্রোটিনের ক্ষরণ হয়। এই রাসায়নিকটিকে হ্যাপি হরমোনও বলে। এই হরমোন স্ট্রেস কমায়, ব্যথা-বেদনার উপশম করে এবং একটা উৎফুল্লতা ও ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে চাঙ্গা রাখে শরীর-মন।’
এন্ডোক্রিনোলজি বিশেষজ্ঞ সুজয় ঘোষ জানাচ্ছেন, নিয়মিত জোরে হাঁটাই হলো শরীরের ভালো কোলেস্টেরল বলে পরিচিত হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এইচডিএল) বৃদ্ধির সবচেয়ে উপযোগী উপায়। পরিচালক সন্দীপ রায়ের নতুন ‘ফেলুদা’ ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও বলছেন, ‘আমি সব খাই। কোনও ডায়েটিং করি না। তার পরেও ছিপছিপে থাকার ফিটনেস মন্ত্র হলো হাঁটা আর ব্যায়াম। রোজ এক ঘণ্টা ব্যয় করি এর জন্য।’ সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাতেও উঠে এসেছে, রোজ হাঁটলে কী ভাবে মানুষের আয়ু বেড়ে যায় এবং কী ভাবে হাঁটা হার্ট অ্যাটাকের মতো অঘটনও প্রতিরোধ করে।
ইউএসএ, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের গবেষকরা একযোগে ১২টি স্টাডিতে অংশ নেওয়া ১,১১,০০০ মানুষের হাঁটার নথি বিশ্লেষণ করেছেন এই গবেষণাপত্রে। দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন যাঁরা অন্তত ২৫০০ স্টেপ ও ২৭০০ স্টেপ হাঁটেন, তাঁদের হৃদরোগে মৃত্যুর আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে কমপক্ষে যথাক্রমে ৮% ও ১১% কম হয়ে যায়। দৈনিক ৭০০০ স্টেপ ও ৯০০০ স্টেপ হাঁটলে সেই আশঙ্কা যথাক্রমে ৫১% ও ৬০% কমে যায় অন্ততপক্ষে। গবেষণাপত্রটিতে আরও দাবি করা হয়েছে, প্রতি ১০০০ স্টেপ বা ১০ মিনিট করে অতিরিক্ত হাঁটার অর্থ হলো ক্রমাগত মৃত্যুর ঝুঁকি কমে, বাড়ে আয়ু।
যদিও ফিটনেস ট্রেনার চিন্ময় রায়ের বক্তব্য, ‘যত লম্বা হাঁটব, তত ক্যালরি বার্ন হবে, সেটা ভুল ধারণা। হাঁটুর বারোটা বাজে তাতে। বিশেষত হাঁটুর ব্যথা ও শরীরের ওজন বেশি থাকলে বেশি হাঁটা বিপজ্জনক।’ তিনি জানাচ্ছেন, অনেকক্ষণ হাঁটলে মানসিক শান্তি হতে পারে, কিন্তু একটা স্তরের পর আর ওজন কমে না। বরং অল্প দূরত্ব জোরে হাঁটলে, অর্থাৎ মাঝমধ্যে ব্রিস্ক ওয়াকিং বা হালকা জগিং করলে ক্যালরি পোড়ে বেশি। টানা লম্বা দূরত্ব হেঁটে গেলে এবং খালি পেটে হাঁটতেই থাকলে পেশির ক্ষতি হয় মারাত্মক।
তাঁর পরামর্শ, নিয়ম করে টানা হাঁটতে না-পারলেও কাজের ফাঁকে যখনই সুযোগ মেলে, তখনই একটু হাঁটাহাঁটি করে নিলেও তার সুপ্রভাব পড়ে শরীরে। হাঁটার সময়ে হার্টরেটও নজর রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। মনে করিয়ে দিচ্ছেন আদর্শ হার্টরেটের ফর্মুলাও। বলছেন, ২২০ থেকে নিজের বয়স বিয়োগ করলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তার ৭০% পর্যন্ত সংখ্যাকে প্রতি মিনিটে হার্টরেটের ঊর্ধ্বসীমা মেনে চলা উচিত। এর বেশি হার্টরেট হয়ে গেলে বিপত্তি এড়াতে হাঁটা, ব্যায়াম থামিয়ে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।