রোগটার নাম সিটাকোসিস। বেশি পরিচিত, প্যারট ফিভার নামে। ইউরোপে সেই প্যারট ফিভারেরই ‘আউটব্রেক’ হয়েছে বলে সম্প্রতি সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পাঁচ জন ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, এই সংক্রমণ পোষা পাখি থেকে মানুষে ছড়ায়। ফলে এ মুলুকেও যে হতেই পারে অসুখটা, সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। রোগটা কী, কেমন ভাবে কাদের হতে পারে, কী তার প্রতিরোধ ও প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য তুলে ধরে আলোকপাত করছেন অনির্বাণ ঘোষ।
* অসুখ পরিচিতি: টিয়া, তোতা, বদ্রী, লাভবার্ড, মুনিয়া ইত্যাদি পাখিগুলোকে সিটাসিন বার্ড বলে। চলতি কথায় বলে প্যারট বা প্যারাকিট। এদের এক রকম ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ হয়। তাকে বলে সিটাকোসিস। চলতি কথায় প্যারট ফিভার। যা মানুষেও সংক্রমিত হয়।
* নেপথ্যে ভিলেন: ক্ল্যামাইডোফিলা সিটাসি নামের একটা ব্যাকটেরিয়া। এটা জুনোটিক সংক্রমণ ঘটাতে পারদর্শী। অর্থাৎ, পশুপাখি থেকে মানুষে ছড়াতে পারে সংক্রমণ।ম* সংক্রমণের মানচিত্র: ইতিমধ্যেই অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডসে ছড়িয়েছে জুনোটিক সংক্রমণ। গত নভেম্বর থেকে অন্তত ৯০ জন আক্রান্ত। মারা গিয়েছেন ৫ জন। প্যারট ফিভারে আক্রান্ত সকলেরই অসুস্থ হয়ে পড়ার ৫-১৪ দিনের ভিতর সংক্রমিত পোষা পাখি হ্যান্ডল করার ইতিহাস রয়েছে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে এখনও কোনও সংক্রমণের নজির নেই।
* উদ্বেগ কোথায়: করোনা পরবর্তী সময়ে ভারতে তথা বাংলাতেও যেহেতু তোতা, টিয়া, লাভবার্ড, বদ্রী, মুনিয়া ইত্যাদি পাখি পোষার চল অনেকাংশে বেড়েছে, অথচ এই জুনোটিক সংক্রমণ নিয়ে তেমন সচেতনতা নেই, তাই বিপত্তির আশঙ্কা রয়ে গিয়েছে। যদিও মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার নজির এখনও নেই কোথাও। তবে কুকুর, বিড়াল ও ঘোড়াও এতে সংক্রমিত হতে পারে।
* কতটা বিপজ্জনক: পাখির ক্ষেত্রে চিকিৎসা না হলে ৩০% পর্যন্ত মৃত্যুহার। বয়স্ক ও ইমিউনিটি কম, এমন মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা যথেষ্ট বেশি। তবে বাকি মানুষের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা বিনা চিকিৎসায় ৫% আর চিকিৎসা করলে ১% বা তারও কম।
* কী ভাবে ছড়ায়: সংক্রমিত পাখির দেহরস ধুলোয় মিশলে তার কণা শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকলে, পাখির মুখ-নাক থেকে বেরোনো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জলকণা বা ড্রপলেট থেকে কাছাকাছি থাকা মানুষের, পাখির চঞ্চুতে আদর করে ঠোঁট লাগালে, সংক্রমিত পাখি বা তার দেহরস স্পর্শ করার পর সেই হাত ভালো করে না ধুয়ে চোখে-মুখে-নাকে দিলে।
* উপসর্গ কেমন: সংক্রমিত হওয়ার ৫-১৪ দিনের মধ্যে জ্বর, কাঁপুনি, মাথা ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, শুকনো কাশি। চিকিৎসা শুরু না হলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট
* চিকিৎসা কী: অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। ডক্সিসাইক্লিন, টেট্রাসাইক্লিন খুব ভালো কাজ করে।
* প্রতিরোধের উপায়: পাখিদের পরিচর্যা বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে, পরিচ্ছন্ন ভাবে, ‘হাইজিন’ মেনে করতে হব পাখির খাবারের পাত্র, জল যাতে জীবাণুমুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকে সেটা দেখতে হবে।
পাখিদের স্বাস্থ্যে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা দেখলে, প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অসুস্থ পাখিকে আলাদা করে রাখতে হবে। চিকিৎসা করাতে হবে।
মৃত পাখি যত্রতত্র না ফেলে দিয়ে, মাটিতে গর্ত করে ২ ফুট গর্ত নীচে চুন-সহ পুঁতে দিতে হবে। পাখি পরিচর্যাকারীর ‘নিজস্ব সুরক্ষা’ সুনিশ্চিত করতে হবে। পোষা পাখির গায়ে মুখ লাগিয়ে আদর করা যাবে না।
* বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য:
১) করোনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংক্রমণ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা যে বেড়েছে, সেটাই ভরসা। কিন্তু সিটাকোসিস ও তার প্রতিরোধ নিয়ে মানুষ তেমন জানে না। ইউরোপের ঘটনা ‘আই ওপেনার’ হতে পারে। — সিদ্ধার্থনারায়ণ জোয়ারদার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট
২) প্যারট ফিভারে মৃত্যুহার ১% বা তারও কম। কিন্তু তা বলে এই সংক্রমণকে লঘু করে দেখার কোনও কারণ নেই। মুশকিল হলো, এর কোনও প্রতিষেধকও নেই। তাই সচেতনতা ও প্রতিরোধই সেরা পন্থা। — সৌরীশ ঘোষ, ভাইরোলজিস্ট