এই সময়: রবিবার বিকেল চারটে। লস অ্যাঞ্জেলসের সানসেট বুলেভার্ড ও হাইল্যান্ড অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে থিকথিকে ভিড়। খানিক দূরেই ডলবি থিয়েটারে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ৯৬তম একাডেমি পুরস্কার বিতরণ। একে একে দুনিয়ার তাবড় সেলিব্রিটিরা ভিড় করেছেন রাস্তায়। কিন্তু তাঁদের গাড়ি বের করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।কারণ, হলিউডের স্বপ্ননগরীর সেই রাস্তা তখন ছেয়ে গেছে প্যালেস্তিনীয় পতাকায়। ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্তাইন’ স্লোগানে রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন হাজার খানেক প্রতিবাদী। গাজ়ায় গণহত্যার প্রতিবাদে রবিবার এমন বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হলো হলিউড।
ডলবি থিয়েটারের বাইরের এই দৃশ্য ভিতরের চোখ ধাঁধানো মঞ্চেও ছায়া ফেলল এ দিন। একের পর এক অভিনেত্রী, কলাকুশলী এ দিন নিজেদের ড্রেসে বা কোটের কলারে লাল বোতাম লাগিয়ে ঢুকেছেন। গাজ়ায় যুদ্ধবিরতির বার্তা দিয়েছে ওই লাল বোতাম। সেই তালিকায় রয়েছে অস্কারজয়ী অভিনেতা মাহেরশালা আলি, এ বছর সেরা সহ অভিনেতার নমিনেশন পাওয়া মার্ক রুফালো, র্যামি ইউসুফ, এই মঞ্চেই বার্বির জন্য অস্কার জয়ী গায়িকা বিলি আইলিশ।
তবে অস্কারের মঞ্চে এ দিন সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ এসেছে সেরা বিদেশি ছবির পুরস্কারজয়ী পরিচালক জোনাথন গ্লেজারের কণ্ঠে। ব্রিটিশ ছবি দ্য জ়োন অফ ইন্টারেস্ট ছবি এ বার সেরা বিদেশি ছবির পাশাপাশি জিতে নিয়েছে সেরা সাউন্ডের পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আউশেভিৎসের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কম্যান্ডার রুডলফ হোসকে নিয়ে তৈরি ওই ছবিতে দেখানো হয়েছে কী ভাবে মৃত্যুশিবিরের পাশেই পরিবার নিয়ে সুখের ঘর বেঁধেছিলেন হোস।
গ্লেজারের ছবির শুটিং বেশির ভাগটাই হয়েছে আউশেভিৎসের অরিজিনাল লোকেশনে। এই ছবির অভিনেতা, কলাকুশলীদের অধিকাংশই ইহুদি। এ দিন পুরস্কার নিতে উঠে গ্লেজার বলেন, ‘অমানবিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে সেটাই আমাদের ছবির বিষয়। আজ এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের ইহুদি পরিচয় ও হলোকস্টের ইতিহাস কেড়ে নিচ্ছে আর একটি আগ্রাসী শক্তি। গত ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে যে ঘটনা ঘটেছে এবং তার পর গাজ়ায় যে ভাবে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, দুটোই মানবিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তার থেকে পরিত্রাণ কোথায়?’
প্রত্যাশিত ভাবেই গ্লেজারের এই মন্তব্যের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ইজ়রায়েল। কিন্তু অস্কারের মঞ্চে এ দিন গাজ়া ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের সোচ্চার প্রতিবাদে চাপা পড়ে গেছে সেই প্রতিক্রিয়া। ওপেনহাইমার ছবির জন্য সেরা অভিনেতা কিলিয়ান মার্ফি তাঁর পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন বিশ্বের সমস্ত শান্তিকামী মানুষকে। সোচ্চারে না হলেও, তাঁর বার্তাও খুব স্পষ্ট।
অস্কারের মঞ্চকে সমসাময়িক রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যবহার করার ঘটনা নতুন নয়। ১৯৭২ সালে গডফাদার ছবির জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন মার্লন ব্র্যান্ডো। কিন্তু নেটিভ আমেরিকানদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে সেই পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রত্যাখ্যান বার্তা অস্কার মঞ্চে পড়ে শোনান এক নেটিভ আমেরিকান অভিনেত্রী।
২০০৪ সালে ফারেনহাইট ৯/১১ তথ্যচিত্রের জন্য পুরস্কার জিতে পরিচালক মাইকেল মুর মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন ‘শেম অন ইউ জর্জ বুশ।’ গণবিধ্বংসী অস্ত্র রাখার অভিযোগে ইরাকে মার্কিন হানাদারির প্রতিবাদে ছিল সেই চিৎকার। কয়েক বছর আগে মেরিল স্ট্রিপ তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। এ দিনও অস্কার অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জিমি কিমেল ট্রাম্পকে নিশানা করেন।
তবে এ দিন সানসেট বুলেভার্ডে যে বিক্ষোভ দেখল হলিউড, তার উদাহরণ বড় একটা নেই। যদিও এই প্রতিবাদকেও সামান্য বলেই মনে করছেন অনেকে। তবুও আলো ঝলমলে ডলবি থিয়েটারের আলোকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে মিছিলে সামিল হওয়া বৃদ্ধ ইহুদি সৈনিক, তরুণী অভিনেত্রী, শরণার্থী প্যালেস্তিনীয় যুবকের সম্মিলিত চিৎকার।