• ‘ক্যায়া হ্যায় ইয়ে ক্যা! পহলে মেরা নাজি়বকো ওয়াপস দো’
    এই সময় | ১৪ মার্চ ২০২৪
  • স্নেহাংশু অধিকারীলাপতা শুধু লেডিজ় নয়। আট বছর ধরে লাপতা জেএনইউ-এর ছাত্র নাজ়িব আহমেদও। যাঁর মায়ের শুধু একটাই কথা— ‘ক্যায়া হ্যায় ইয়ে ক্যা (সিএএ)? পহলে মেরে বেটেকো ওয়াপস দো।’

    দেশ জুড়ে চালু সিএএ। এই রুট ধরেই কি দেশব্যাপী এনআরসি লাগু করবে কেন্দ্র! রাষ্ট্র কি তা হলে ফের নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইবে? তারপর? কাগজের চক্করে সরকারি খাতা থেকে নাম বাদ গেলে ভবিতব্য কি ওই অসমের মতো ডিটেনশন ক্যাম্প? ২০১৯-এ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) পাশের পরপরই এমন নানাবিধ আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল ঘরে-ঘরে। প্রতিবাদে উনিশের হাড়কাঁপানো ডিসেম্বরেও তপ্ত হয়ে উঠেছিল দিল্লির শাহিনবাগ।

    ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’— অশক্ত শরীর নিয়েই সেবার উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁ থেকে সটান দিল্লি পৌঁছে গিয়েছিলেন ‘নিখোঁজ’ নাজ়িবের মা ষাটোর্ধ্ব ফতিমা আহমেদ। হাতে প্ল্যাকার্ড, পিঠে ব্যথা, আর গলায় অসম্ভব একটা তেজ। গত চার বছরে শিরদাঁড়ার ব্যথা অনেকখানি বেড়েছে। কিন্তু ভেতরের ঝাঁজটা মরেনি।

    সোমবার দেশ জুড়ে সিএএ কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। সেই খবর কানে যেতেই নাম না-করে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধেই ফুঁসে উঠলেন ফতিমা। ফোনে এই সময়-কে বললেন, ‘পহলে উনকো কাগজ় দিখানা হোগা কে মেরা বেটা কাহা গুম হ্যায়! ওরা শুধু মুখেই বলে— মেয়েরা মায়ের জাত। আসলে রাজনীতি ছাড়া ওরা কিছু বোঝে না। মায়ের কষ্ট তো নয়ই। অনেক আগে থেকেই মানুষ লোপাটের ছক কষে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। উচ্চ বর্ণের হিন্দু ছাড়া ওরা দেশের সবাইকে তাড়াতে চায়। নোটবন্দি, গণপিটুনির পর আবার নাগরিকত্বের জুজু দেখানো শুরু করেছে। লেকিন হম ভি দেখেঙ্গে। আখরি দম তক বেটে কা ইন্তেজ়ার ভি করেঙ্গে।’

    ২০১৬-র ১৫ অক্টোবর। ক্যাম্পাস থেকেই রাতারাতি ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যান নাজ়িব। অভিযোগ, তার আগের দিনই এবিভিপি-আশ্রিত গুন্ডারা তাঁকে বেধড়ক মেরেছিল। সেই নাজি়ব এখনও নিখোঁজ। দিল্লি পুলিশ, ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাত ঘুরে কেস যায় সিবিআই-এর কাছে। দু’বছরের মাথায় হাত তুলে নেয় তারাও। মা কিন্তু নাছোড়ই। একদিনের জন্যও ফোন বন্ধ করেননি। গত আট বছরে একটা কল-ও মিস করেননি— ছেলেটা ফোন করে যদি না পায়!

    নাজ়িবের ‘মিসিং কেস’ এখন সুপ্রিম কোর্টে। আপডেট কী? ফোনের ও-পারে চোস্ত উর্দু মেশানো হিন্দিতে ফের গলা চড়ল ফতিমার— ‘ওখানে তো শুধু তারিখ-পে-তারিখ! নাজ়িবের কেস উঠলেই দেখি জাজরা সব ছুটিতে চলে যান। পতা নেহি, চৌকিদার কো অউর কিতনে বার চৌকিদারি ইয়াদ দিলানা পড়েগা। নিজের লোকেদের ফ্রি-তে রেশন, আনাজ বিলির পর উনি এখন ধর্ম নিয়ে কাগজ-কাগজ খেলায় মেতেছেন।’

    সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে সাফ বলা আছে— ২০১৪-র আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ-পার্সি-খ্রিস্টানরাই শুধু নাগরিকত্ব পাবে। মসুলিমরা বাদ। কেন? সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষ দেশ কি আদৌ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দিতে পারে? মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গারাই বা বাদ কেন? চার বছর আগেই এ সব প্রশ্ন তুলেছিল শাহিনবাগ।

    কেন কোনও পাকিস্তানি মুসলিম শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না? এই প্রশ্ন তোলায় সে বার গেরুয়া হুঙ্কার এসেছিল— ‘পাকিস্তান যা কর মরো’। কিংবা ছন্দ মিলিয়ে— ‘দেশ কি গদ্দারোকো, গোলি মারো শালোকো।’ সেই প্রসঙ্গ উঠতেই ‘নাজ়িবের মা’ ফের ‘শাহিনবাগের মা’। বিরানব্বইয়ে প্রথম এবং শেষ বার পাকিস্তানে গিয়েছিলেন ফতিমা।

    পাকিস্তানের নাম শুনেই তাই চিড়বিড়িয়ে উঠলেন, ‘কেন পাকিস্তানে যাব? পাকিস্তানের কথা তো আমাদের মনেও নেই। এই হিন্দুস্তানের মাটিতেই আমার চোদ্দো গুষ্টির জন্ম, বিয়ে, কাচ্চাবাচ্চা। এখানেই মরব। ইয়েহি মিট্টি পর মিট জায়েঙ্গে।’

    ঠিক দু’বছর আগে ফতিমার ছবি-সমেত নাম উঠেছিল ‘বুল্লি বাঈ’ অ্যাপে। শ’খানেক ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের ‘অনলাইন মক নিলাম’। ১৭ থেকে ৭০— যাদের নাকি চাইলেই বাঁদি করে হারেমে তোলা যায়! ঘটনাচক্রে ওই লিস্টের একজনও কিন্তু অবলা ছিলেন না। বরং সকলেই কোনও না কোনও সময়ে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিলেন।

    ছেলের পথ চেয়ে থাকা ফতিমা তখনও নিজেকে খাটো করেননি। এখনও না। ইদানীং চার পা হাঁটলেই হাঁফিয়ে যান। কিন্তু ভেতরের গনগনে আঁচটা প্রাণপণে বাঁচিয়ে রেখেছেন। রমজানের নমাজ পড়তে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘পরিবারকে জানিয়ে ওয়াসিয়তনামায় লিখে রেখেছি, মৃত্যুর পরে দাদা-পরদাদার কবরের পাশেই যেন আমাকে দাফন করা হয়। সরকার কাগজ চাইলে এ বার ওটাই দেখাব। লেকিন দম হ্যায় তো উও পহলে জবাব দে— মেরা নাজ়িব কাহা হ্যায়?’
  • Link to this news (এই সময়)