‘এ দেশের সংখ্যালঘুর জন্য অ্যাপ বানাই, লড়ি, আমি বিরোধী’
এই সময় | ১৭ মার্চ ২০২৪
রূপসা রায়
তাঁর যা স্কিল, যা প্রোফাইল, চাইলে এত দিনে মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারতেন তিনি। কিন্তু সে পথে না হেঁটে নিজের ‘কমিউনিটি’-র জন্য, ভারতের অত্যাচারিত সংখ্যালঘুর জন্য কাজ করতে চেয়েছেন হায়দরাবাদের সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র খালিদ সাইফুল্লাহ। মোদীর ভারতে মুসলিমরা যে সমস্যার সম্মুখীন, তা দূর করতে বদ্ধপরিকর তিনি।তাঁর হাতিয়ার অ্যাপ, যা তিনি নিজে বানিয়েছেন, বানাচ্ছেন। এনআরসি, সিএএ-র বিরোধিতা করা থেকে মিসিং মুসলিম ভোটারদের খুঁজে বার করা— সবের জন্যই তিনি বানিয়েছেন অ্যাপ। এবং সেই অ্যাপ ডাউনলোডও করছেন বহু মানুষ। বছর পঁয়তাল্লিশের এই মানুষটির বক্তব্য, তাঁর নানা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার দক্ষতাকে সমাজের উন্নতির কাজে লাগাও। না হলে, শেষ বিচারের দিনে ওই দক্ষতাই তোমার গলার ফাঁস হবে।’
কথাটি মনে রেখেছেন সাইফুল্লা। তাই, গুগল, ডেল, ইনোভা সলিউশনস-এর সঙ্গে কাজ করার পরে যখন কেরিয়ার তাঁর তুঙ্গে, তখনই নিজের স্বার্থচিন্তা না চেষ্টা করছেন, ডিজিটালি ভারতীয় মুসলিমদের কতটা সাপোর্ট দেওয়া যায়। যাতে কোনও সমস্যায় পড়লেই তারা তাঁর বানানো অ্যাপের মাধ্যমে সমাধান করতে পারেন।
শুরু হয়েছিল ২০০৭-এ, গুগল ইন্ডিয়ায় যোগ দেওয়ার সময়ে। অন্ধ্রের মুসলিম পড়ুয়াদের সুবিধার জন্য বানান সেল্ফ প্র্যাক্টিস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্ট সফ্টওয়্যার। যাদের পড়ার সামর্থ্য নেই, তাঁদের জন্যই ছিল এই ব্যবস্থা। ২০১৬-র ১৫ অগস্ট তিনি মুসলিম ফ্রিডম ফাইটারস অ্যাপ লঞ্চ করেন। ২০১৭-এ তিন তালাকের বিষয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড যাতে ল’ কমিশনের কাছে তাঁদের মত জানাতে পারে, তার জন্যও অ্যাপ বানান।
২০১৯ এ সিএএ-র বিরুদ্ধে শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়ে অ্যাপ বানান, যা ডাউনলোড করেছিলেন ৭২ হাজারেরও বেশি মানুষ। এই অ্যাপ ব্যবহার করে তাঁরা তাঁদের সিটিজ়েনশিপ ডকুমেন্ট ভেরিফাই করা থেকে শুরু করে নিজেদের বংশলতিকা বানানো থেকে ওই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিবাদী কর্মসূচি নিয়েও ওয়াকিবহাল থাকতে পারতেন।
কিন্তু এই অ্যাপগুলির বেশির ভাগই এখন কাজ করে না। বানিয়েছিলেন শাহিনবাগ অ্যাপও। সেই অ্যাপে ছিল ১০০টিরও বেশি প্রবন্ধ, বহু ইন্টারভিউ, ভিডিয়ো, অডিয়ো ক্লিপ। বানিয়েছেন ‘মিসিং ভোটার অ্যাপ’। সেটার মাধ্যমে জাত-ধর্ম নিবিশেষে বহু মানুষ ভোটার হিসেবে নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন। বিশেষ করে গ্রামীণ গরিব নারীরা, যাঁরা বসতি এলাকায় থাকেন।
সাফিউল্লাহ বলেন, মুসলমান ও দলিত সম্প্রদায়ের বহু মানুষই জানেন না, ভোটার লিস্টে নাম রয়েছে কি না। তাঁরা যাতে ভোট দিতে পারেন, তার জন্যই ছিল অ্যাপটি, যার কার্যকারিতা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী স্মিতা চৌধুরী। তিনিও নিজের লোকসভা এলাকা থেকে বহু ভোটারের নাম নথিভুক্ত করানোয় এই অ্যাপেরই সাহায্য নিয়েছিলেন।
সাইফুল্লাহ এ সবই করেছেন, ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীর আত্মরক্ষায় সাহায্য করার জন্য। ফলে অনেকেই বলছেন, সাইফুল্লাহর অ্যাজেন্ডা রয়েছে! আছে তো বটেই। আর সেই অ্যাজেন্ডার কথা তো সরাসরি বলেই দিচ্ছেন সাইফুল্লাহ। আইটি ও স্টেমে মুসলিমদের চাকরি করতে দেখতে চান তিনি। তাঁর বার বার তাঁর নানা-র সেই কথাটাই মনে পড়ে। আর নানা-র স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতেই তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন।
কে কী বলল, তাঁর কিছু যায় আসে না! বরং, কোন আখ্যায় বাঁধা যাবে তাঁকে, তা নিয়েই সংকটে পড়তে পারেন চারপাশের মানুষ। তিনি আসলে কে? অ্যাপ ডেভেলপার, রাজনীতিবিদ নাকি সমাজকর্মী? আসলে তাঁর জীবন দর্শন যা, তা তিনি জড়িয়ে নিয়েছেন তাঁর পেশার সঙ্গে। আর সেখানেই তিনি অনন্য।
আর সাইফুল্লাও নিজেকে ওই ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চান না। তিনি বলছেন,‘এই যে আমি, সংখ্যালঘুদের জন্য। আমি বিরোধী। খেলা শুরু হোক!’