• আনন্দ-শপথে শুভেন্দুকে দিদি নো বল করলেন না মাঁকড়ীয় আউট, খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন ২৪ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৪৪
    আনন্দবাজার | ২৪ নভেম্বর ২০২২
  • শপথে আসন-বিতর্ক নিয়ে জোর চাপান-উতোর বাংলার রাজ্য রাজনীতিতে। নতুন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের শপথের দিনই শুরু হয়ে গিয়েছে শাসক-বিরোধী সংঘাত। শুরু হয়েছে বিতর্ক। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতার আসন কি একই সারিতে হওয়া উচিত? কী বলছে দেশের নিয়ম? কী বলছে রাজ্যের প্রোটোকল?

    বুধবার রাজ্যপালের শপথে আমন্ত্রণ পেয়েও যাননি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, দ্বিতীয় সারিতে তাঁর আসন বণ্টন করে বিরোধী দলনেতার পদটিকে অপমান করা হয়েছে। প্রথম সারিতে আসন ছিল মুখ্যমন্ত্রী, বিধানসভার স্পিকার, রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে শাসক তৃণমূলের কয়েক জন সাংসদেরও। বিজেপির বক্তব্য, বিরোধী দলনেতা (যিনি পদাধিকার বলে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমতুল) বসবেন দ্বিতীয় সারিতে। আর শাসকদলের সাংসদরা বসবেন প্রথম সারিতে— এ কেমন আসনবিন্যাস?

    এ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে যে নিয়ম রয়েছে, তাতে শুভেন্দুর দাবি ফেলে দেওয়ার নয়। পাশাপাশিই, এই রাজ্যে এত দিন যে ‘রীতি’ চলে এসেছে, বুধবারের আসন বণ্টনে তা-ও মানা হয়নি। এমনই বলছেন বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা থেকে রাজ্যের প্রাক্তন আমলাদের একাংশ। তবে তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় মনে করেন, বিরোধী দলনেতার আসন প্রথম সারিতে না হলে ‘মহাভারত অশুদ্ধ’ হয় না!

    রাজ্যপালের শপথ অনুষ্ঠান মূলত রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ব্যবস্থাপনাতেই হয়। প্রধান প্রোটোকল অফিসার হিসাবে আমন্ত্রণ পাঠানো হয় মুখ্যসচিবের তরফে। নতুন রাজ্যপালের শপথের আগে রাজ্যপালের সচিবও রাজ্য সরকারের সেই ব্যবস্থাপনার নিগড়েই বাঁধা থাকেন। কী বলছে সেই ব্যবস্থাপনার নিয়ম অথবা রীতি?

    পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন শাখার (ব্রাঞ্চেস অ্যান্ড সেল্‌স) যে তালিকা রয়েছে, তার মধ্যেই একটি ‘প্রোটোকল ব্রাঞ্চ’। সেখানে উল্লেখ রয়েছে এই শাখার কাজগুলির। তার মধ্যে রাজ্যে কোনও অতিথির সফর, শপথগ্রহণ থেকে নানা সরকারি অনুষ্ঠানের তালিকা রয়েছে। তবে সেখানে রাজ্যপাল বা অন্য কারও শপথে কেমন ‘প্রোটোকল’ মানা হবে তার উল্লেখ নেই।

    তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই তৈরি ২০১৯ সালের সচিবালয়ের ব্যবহারবিধি (সেক্রেটারিয়েট ম্যানুয়াল)-তে ‘প্রোটোকল’ নামে একটি অংশ রয়েছে। সেখানেও আসন বণ্টন-সহ অন্যান্য নিয়মকানুন সে ভাবে বলা নেই। তবে উল্লেখ রয়েছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের হাতেই রয়েছে ‘প্রোটোকল’ বিভাগ। বলা আছে, মুখ্যসচিব রাজ্যের প্রধান প্রোটোকল অফিসার। একই সঙ্গে বলা রয়েছে, কোনও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের। অতিথিদের যাতায়াতের দায়িত্ব পরিবহণ দফতরের। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি দফতরের পক্ষেও আবার এক জন করে প্রোটোকল অফিসার নিয়োগ করার নিয়ম। তবে কোথাওই আসনবণ্টন নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলা নেই।

    অর্থাৎ, বিরোধী দলনেতার আসন যে প্রথম সারিতেই থাকবে হবে, তেমন কোনও নির্দিষ্ট আইনকানুন বা নিয়ম অন্তত পশ্চিমবঙ্গে নেই। সে দিক দিয়ে বলতে গেলে শুভেন্দুকে দ্বিতীয় সারিতে বসতে দিয়ে রাজ্য সরকার ‘আইন’ বা ‘নিয়ম’ ভাঙেনি।

    তবে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন মনে করেন, লিখিত কিছু থাকুক বা না থাকুক, ‘প্রথা’ তথা ‘রীতি’কেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘সব কিছুই যে লিখিত থাকবে, তা নয়। এত দিন কী হয়েছে বা কোন রীতি চলে আসছে, সেটাই সবার আগে ভাবা উচিত। সেই হিসাবে অতীতে যদি রাজ্যপালের শপথে প্রথম সারিতে মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধী দলনেতার আসন হয়ে থাকে, তবে সেটাই করা উচিত।’’

    প্রায় একই কথা বলেছেন রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রাক্তন আইএএসের বক্তব্য, ‘‘অতীতে অনেক শপথেই থেকেছি, দেখেছি এবং আয়োজন করেছি। রাজ্যের এই ধরণের অনুষ্ঠানে বিরোধী দলনেতার আসন প্রথম সারিতে হওয়াই রেওয়াজ। নিয়মে ঠিক কী বলা রয়েছে, এখনই তা মনে না পড়লেও এটা ঠিক যে, বিরোধী দলনেতা যেহেতু এক জন পূর্ণমন্ত্রীর সমমর্যাদার, তাই তাঁর আসন কখনও দ্বিতীয় সারিতে সাংসদদের পিছনে হওয়া ঠিক নয়। সেটা হয়ে থাকলে অন্যায় হয়েছে।’’

    অর্থাৎ ‘আইন’ নয়, দিদি ‘রীতি’ ভেঙেছেন। তেমনই মনে করছেন প্রাক্তন শীর্ষ আমলারা। যেমন ক্রিকেটে ‘মাঁকড়ীয় আউট’ (বোলার হাত থেকে বল ছাড়ার আগে নন স্ট্রাইকার রান নিতে ক্রিজ় ছেড়ে বেরিয়ে গেলে সেই সুযোগে বল ডেলিভারি না করে তাঁকে রান আউট করা)। আইনবিরুদ্ধ নয়। কিন্তু রীতিবিরুদ্ধ। কেউ করলে আইনি চৌহদ্দি ভেঙেছেন বলা যাবে না। কিন্তু ক্রিকেটীয় সৌজন্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়ে যাবে। প্রাক্তন আমলাদের একাংশের মতে, দিদি ‘নো বল’ করেননি। কিন্তু ‘মাঁকড়ীয় আউট’ করেছেন।

    পশ্চিমবঙ্গে আলাদা করে শপথে আমন্ত্রণ ও গুরুত্বের কোনও লিখিত প্রোটোকল না পাওয়া গেলেও অন্য অনেক রাজ্যেরই তা রয়েছে। তাতে কেন্দ্রেরই অনুসরণ দেখা গিয়েছে। কেরল সরকারের ওয়েবসাইটে যে তালিকা রয়েছে, তাতে রাজ্যের মন্ত্রীদের সমান গুরুত্বের কথাই বলা রয়েছে বিরোধী দলনেতার। একই সঙ্গে এমন উল্লেখও রয়েছে যে, প্রোটোকলের হিসাবে বিরোধী দলনেতার পরে গুরুত্ব পাবেন সাংসদরা। ঘটনাচক্রে, আনন্দ নিজে কেরলে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব ছিলেন। তাঁর আমলে এই রীতিই অনুসরণ করা হয়েছিল।

    রাজ্যের কি নির্দিষ্ট কোনও লিখিত প্রোটোকল নেই? অর্ধেন্দু বলেন, ‘‘১২ বছর আগে অবসর নিয়েছি। এখন অতটা বিশদে মনে নেই। তবে সব সময়ে তো আর লিখিত নিয়ম দেখে আয়োজন হয় না! কোনও বিশেষ কারণ ছাড়া প্রচলিত নিয়মই মেনে চলতে হয়। তা ছাড়া রাজ্যের না থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিত প্রোটোকল রয়েছে। রাজ্যকে যদি প্রোটোকল বানাতে হয়, তবে তা কেন্দ্রের নিয়ম দেখেই করতে হয়। আলাদা প্রোটোকল না থাকলে কেন্দ্রের পদ্ধতিই মেনে চলতে হয়। এটাই নিয়ম।’’ অর্ধেন্দুর সংযোজন, ‘‘তবে সবার আগে দেখা দরকার অতীতে কী নিয়ম মানা হয়েছে। রীতি মানাটাই শোভন।’’

    অতীতের রীতি প্রসঙ্গে বুধবারেই বিধানসভার প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতাকে প্রথম সারিতেই বসতে দিতে হবে, এমন কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে সেটাই চালু রীতি। সেই ব্যবস্থা না রাখা ঠিক হয়নি।’’ প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের শপথের দিন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা হিসাবে তাঁকে প্রথম সারিতে বসতে দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান মান্নান।

    মান্নানের বক্তব্য সম্পর্কে অর্ধেন্দু বলেন, ‘‘এটা যদি অতীতে হয়ে থাকে, তবে এ বারেও তা মান্য করাই উচিত ছিল।’’ এই প্রসঙ্গে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রসঙ্গও টেনে আনেন অর্ধেন্দু। প্রসঙ্গত, প্রথমে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া মুকুল রায় এবং এখন কৃষ্ণ কল্যাণীকে ওই পদে বসানো হয়েছে। অর্ধেন্দু বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রেও কোনও লিখিত নিয়ম না থাকলেও রীতি অনুযায়ী ওই পদ বিরোধীদলের কোনও বিধায়কের প্রাপ্য। কারণ, নিজের লোক কখনও সরকারের আর্থিক অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলতে পারেন না।’’

    সোমবার রাজভবনে প্রোটোকল ভাঙারই অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। বুধবার আনন্দের শপথে হাজির ছিলেন সস্ত্রীক রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে রাজ্যপালের দু’দিকে বিশিষ্টদের বসার বন্দোবস্ত ছিল। বাঁ দিকে প্রথম সারির প্রথমেই ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন। তাঁর ডান পাশে যথাক্রমে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। প্রথম সারিতে জায়গা পেয়েছিলেন তৃণমূলের চার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালা রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আর রাজ্যপালের ডান দিকে প্রথম সারিতে আসন ছিল গোপালকৃষ্ণের। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের যে প্রোটোকল, তাতে প্রাক্তন রাজ্যপালের জন্য প্রথম সারির আসনের কথা আলাদা করে বলা নেই। বিজেপি অবশ্য তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তবে দলের বক্তব্য, কাউকে আলাদা করে সম্মান দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু কোনও পদাধিকারীর অসম্মান করা যায় না। সেটাই আসল রীতি।

    তবে তৃণমূল এই বিতর্ককে একেবারেই গুরুত্ব দিতে চাইছে না। সে ভাবে দলের তরফে কোনও মন্তব্যও করা হয়নি। তবে দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘এটা শুধু শুধু বিতর্ক। আমাকে পিছনের সারিতে বসতে দিলেও আমি কিছু মনে করতাম না।’’

    কিন্তু রীতি কী বলছে? বুধবার রাজভবনে আনন্দের শপথে না-থাকলেও তিনি অতীতে অনেক সরকারি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। সেখানে কী দেখেছেন? সৌগত বলেন, ‘‘আমি অনেক সময় বিরোধী দলনেতাকে প্রথম সারিতে বসতে দেখেছি। আবার পিছনের দিকে বসেছেন সেটাও দেখেছি। কে কোথায় আসন পেল, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না!’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)