• New Jersey: চেরিব্লসমের দেশে বর্ষবরণ
    আজকাল | ১৩ এপ্রিল ২০২৪
  • সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়, নিউ জার্সি:‌ একটা বাংলা বছর বারোটা মাস, ছটি ঋতু পেরিয়ে ক্যালেন্ডারের শেষ পাতায় পৌঁছে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় করছে। উদাসী মরশুমের মনও বদলে যাচ্ছে। ফাল্গুনী শীতল হাওয়াটুকুও চৈত্র শেষে ধীর লয়ে উষ্ণতার দিকে। তুষারের ব্ল্যাঙ্কেট এখন অতীত, পাতাহীন গাছে গাছে দোল খেলছে বসন্তের রংবাহার। চেরি ফুলের গোলাপি আবীর আভায় ,অন্যমনস্ক পাখীদের কলতানে মন চলে যাচ্ছে অশোক পলাশের দেশে, বিরহী কোকিলের কুহুতানে যেখানে সেজে উঠছে পয়লার ডাক। “April is the cruelest month…” বলেছেন এলিয়ট, তবে বিশ্বের আপামর বাঙালির কাছে এই উদাসীন এপ্রিল বসন্তের বিষণ্ণতাকে ছাড়িয়ে এক নতুন শুরুর মাস! আমেরিকা ও কানাডায় এই উৎসব শুধু পালিতই হচ্ছে না, দিনে দিনে এর আয়োজন–উন্মাদনা ও ভালবাসার পরিসর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিউ জার্সির পাড়ায় পাড়ায় এখন বাঙালি ক্লাবের ছড়াছড়ি। তাই এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে মে পর্যন্ত গড়াবে প্রত্যেক উইকএন্ডের বিভিন্ন ক্লাবের নিজস্ব স্টাইলে বর্ষবরণ উদযাপন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা বাঙালির লোক সংস্কৃতিতে কবিতা, গানে, নাচে, আলপনায় সেজে উঠবে নতুন বৈশাখের আঙিনা। আমাদের প্রবাসে নাই বা থাকুক চড়কের মেলায় মন্ত্রপূত ঘিয়ে বাণবিদ্ধ হওয়ার কঠোর তপস্যা বা ফুটপাথে ছড়ানো চৈত্রসেলের হাতছানি। কিংবা মা–বাবার হাত ধরে ফুরফুরে নতুন ফ্রকের হালখাতা করতে করতে হাতে জমে ওঠা ঠাকুরের ছবির প্যাঁচানো ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির ছোট্ট ছোট্ট প্যাকেট। আমাদের নিউ জার্সির ক্লাবে ক্লাবে বৈশাখী মঞ্চে আছে ফ্রিল লাগানো হাতপাখার দেওয়াল জোড়া সাজ, আলপনা আঁকা ঘট, কুলো, সিঁদুরের গাছকৌটো। মিশিগান থেকে মেরিল্যান্ডের বৈশাখী বৈঠকীর হাওয়ায় ওড়ে বাঙালিয়ানার লিনেন আঁচল, গঙ্গা যমুনা পাড়ের ধনেখালির ধানরং, চওড়া পাড়ের কলকাতার ছবিওয়ালা টাঙ্গাইল, ধাক্কা পাড়ের রঙিন ধুতি আর ঢাকাইয়ের রকমারি রঙের কুর্তার বাহার। হয়ত পুরুলিয়ার পলাশের মালা গলায় মাতাল সুরের মাদল তান নেই, তবে আছে পোড়ামাটির পলাশ রঙ মালা গলায় খোদ নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে বাংলার আপন ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ঐকান্তিক প্রয়াস। আছে বেসমেন্টের ঘরোয়া আড্ডায় গামছা শাড়িতে সেজে মাইকেলের ভাষায় আমাদের নিজস্ব কৃষ্টিকলার “বিবিধ রতন”–এর সৃজনসম্ভার। আছে পুরাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনকে মিলিয়ে পূব পশ্চিমের সংস্কৃতির নবীনকরণ। শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাট হয়ত নেই, কিন্তু পেনসিলভেনিয়ার পার্কের সবুজ মাঠে বৈশাখী মেলায় আছে ডোকরার গয়না, টেরাকোটার মালা, আফগানি সিলভারের সেট, পোড়া মাটি, বেতের ঘর সাজানোর রকমারি এবং বৈশাখী ইদ বাজারে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক গ্রামের শিল্পীদের তৈরি শাড়ির সম্ভার। বৈশাখী প্যান্ডেলের পেটপুজোতেও কিন্তু প্রবাসের বাঙালি পিছিয়ে নেই। বিভিন্ন ক্লাবের হেঁশেলে তাই কোথাও গন্ধরাজ লেবুপাতার ডাল কিংবা কোথাও কাতলা মুড়ো দিয়ে ভাজা মুগের ডাল, বেগুনি কিংবা ফিস ফ্রাই, সরু চালের ভাত না হয় বাসন্তী পোলাও, কোথাও ভেটকি পাতুরী কোথাও ইলিশ ভাপা। এ ছাড়া লুচি, পাঁঠার মাংস, আলুর দম, ঘুগনি, বেকড রসগোল্লা, বগুড়ার দই। কোথাও বিভিন্ন বাহারি ভর্তা পদের সঙ্গে থাকে ইলিশ ভাজা আর পান্তা ভাতের আয়োজন। আপনার যা খেতে মন চায় মেনু দেখে পৌঁছে যান সেই ভেনুতে। যদিও প্রবাসে পঞ্জিকার দিনক্ষণ মিলিয়ে নয়, ছুটির দিন দেখে উদযাপিত হয় যে কোনও উৎসব, তবে এবছর প্রবাসী বাঙালির পোয়া বারো কারণ রবিবার ছুটির দিনেই বর্ষ শুরুর দিন। গত বছর থেকে সংস্কৃতিপ্রেমী শত শত মানুষ জড়ো হচ্ছেন ঐতিহাসিক নিউ ইয়র্ক টাইমস স্কোয়ারে। ঢাকার ছায়ানটের মতো সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতী অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বছর উদযাপন। সাদা লাল পাঞ্জাবি বা কুর্তার সঙ্গে জিনস, সাদা লাল ঢাকাইয়ে আলতা রাঙা পায়ে শুরু হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী, পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসীরা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠছেন‘এসো হে বৈশাখ’.‌.‌.‌ টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য দেখে গর্বে নেচে উঠছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়।এবছরও ১৩ই এপ্রিল, শনিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলবে আমাদের আনন্দ–অনুষ্ঠান।
  • Link to this news (আজকাল)