সুপর্ণা বিশ্বাস
চড়ক পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব৷ বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বা চৈত্র মাসের শেষ দিনে তথা বছর শেষে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে৷ এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা দেবাদিদেব মহাদেবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ৷ রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ-ই হচ্ছে ‘গাজন’৷ গাজন অর্থে (গাঁ= গ্রাম, জন= জনগণ) অর্থাৎ এককথায় গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব৷ বাংলা ‘গাজন’ শব্দটি গর্জন শব্দ থেকে বু্যৎপন্ন হয়েছে৷ এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এইরূপ নামকরণ করা হয়৷
চড়ক পূজা চৈত্র সংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয়৷ এই পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম নীলপূজা৷ পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়৷ এরপর জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা ‘শিবের পাটা’ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত৷ পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন৷ পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা ইত্যাদি৷
ইতিহাস বলে লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই৷ পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না৷ তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল৷ উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়৷ জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেছিলেন৷ কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে আকাঙ্খায় ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন৷ সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন৷
পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়৷ যা প্রাচীন সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ৷ যেমন, চড়কগাছে সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়৷ তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়৷ কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁডে় দেয়া হয়৷
পূজার উদ্যোক্তা তথা ভক্ত অথবা সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করেন৷ একজনকে সাজানো হয় হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল; স্থান বিশেষে রামায়ণ কাহিনীর হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনার দৃশ্য অভিনীত হয়, একে বলে ‘গিরি সন্ন্যাস’৷ এরপর সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আমগাছ থেকে একাধিক ফলসমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন, এর নাম ‘বাবর সন্ন্যাস’৷ চড়কপূজার আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয় (যা মূলত নীলপূজা নামে পরিচিত), এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়৷ দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী৷ সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর৷ তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল৷ সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে৷ এদেরকে ‘নীল পাগলের দল’-ও বলা হয়৷ এরা বাডি় বাডি় ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে৷ বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা৷ এদিন রাতে ‘হাজরা পূজা’ হয় এবং শিবের উদ্দেশ্যে খিচুডি় ও শোল মাছ নিবেদিত হয়৷ মাঝরাতে শিবের আরাধনার সময়ে দু’একজন সন্ন্যাসী প্রবলবেগে মাথা ঘুরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পডে়ন, এই অবস্থাকে দেবতার ভর বলা হয়৷ এসময় তারা দর্শকমণ্ডলীর প্রশ্নের যা যা উত্তর দেয় তা অভ্রান্ত বলে সাধারণে বিশ্বাস করে৷
চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে৷ এছাড়া, দেবতার অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা’দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন৷ এগুলি যথাক্রমে ‘বঁটি-ঝাঁপ’, ‘কাঁটা-ঝাপ’ ও ‘ঝুল-ঝাঁপ’ নামে পরিচিত৷ আরও আত্মনির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা সারাদিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেওয়া হয়, এর নাম ‘বাণ-সন্ন্যাস’৷ পিঠের দু’দিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকে বলে ‘বেত্র-সন্ন্যাস’৷ আর চড়ক গাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়, যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে৷ এর একপ্রান্তের ঝোলানো দডি়তে একজন সন্ন্যাসী (আগেকার সময়ে সন্ন্যাসীরা পিঠের চামড়া ভেদ করে শিরদাঁড়াতে বঁড়শির মত বাঁকানো একটি লোহার কাঁটা গেঁথে ঝুলে থাকতেন) কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপরপ্রান্তে কাষ্ঠখণ্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মত ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘বড়শি সন্ন্যাস’৷ এই সমস্ত প্রকার নিয়মের মধ্যে দিয়েও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আজও বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে, যেটি চড়ক সংক্রান্তি অথবা চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অথবা চড়ক মেলা নামে অভিহিত৷