• Lionel Messi: মেসি যেন পথের পাঁচালীর অপু
    আজকাল | ২৮ নভেম্বর ২০২২
  • মুনাল চট্টোপাধ্যায়, দোহা

    ‘‌দৌড়, দৌড়, দৌড়!‌’‌ মেসি যেন পথের পাঁচালীর অপু।

    কাশবন পেরিয়ে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার যে ছুট, তার সঙ্গে এই দৌড়ের কিঞ্চিৎ তফাত আছে। তবে সারল্যের সুখ আর দিগন্তের নতুন রেখা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ এক।

    গ্যালারিতে তখন মুহুর্মুহু নীল–সাদা ঢেউ। যেন রোজারিও পারানা নদী!‌ সেই নদীতটে এসে দাঁড়ালেন লিওনেল মেসি। মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ঝাঁকালেন। বলতে চাইলেন, ‘‌পেরেছি। আমি পেরেছি।’‌ ফুরিয়ে যাননি, হারিয়ে যাননি। বেলাশেষের গল্প এখনও বাকি। 

    ততক্ষণে সতীর্থরা পৌঁছে গেছেন কাছে। আলিঙ্গনের মাখামাখি উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। সেই উষ্ণতা গায়ে মাখতে মাখতেই একটু সরে এলেন। আবার তাকালেন আকাশের দিকে। কাউকে কি খুঁজলেন?‌ ঈশ্বর?‌ নাকি মারাদোনা?‌ তাঁর কাছে অবশ্য দুই–ই সমার্থক। তারপর ‘‌ভ্যামস, ভ্যামস’‌ চিৎকার করে উঠলেন। মেসি যে ভাষায় কথা বললেন, অন্য সময় বুঝতে অনুবাদক লাগে। কিন্তু কিছু মুহূর্ত আপনা–আপনি ভাষা হয়ে ওঠে!‌ যা বলছেন আর যা বলতে চাইছেন, তখন সব একাকার। 
    মুহূর্তেরা বড়ই খামখেয়ালি। রোজ, রোজ এক নিয়মে আসে না। তবে যেদিন আসে, মাতাল বাতাসও হার মানে। 

    ভিড়ের মাঝে ছিটকে বেরিয়ে বলটা পায়ে ধরতেই সন্ধানী চোখ খুঁজে নিয়েছিল মেক্সিকো ফুটবলারদের পায়ের জটলায় সূক্ষ্ম ঘুলঘুলি। ব্যস, ওটুকুই যথেষ্ট হয়। একফালি রোদ আর তাঁর জন্য। বাঁ পায়ের নিখুঁত গড়ানো শট বাঁক খাইয়ে গোলকিপার ওচোয়ার হাতের নাগাল এড়িয়ে পাঠালেন জালে। লুসেইল স্টেডিয়ামের কানায় কানায় ভরা গ্যালারিতে সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ ব্রহ্ম। গোলল্‌ল্‌.‌.‌.‌। 

    এই গোল, এই মেসিকে দেখার জন্য এক পৃথিবী হাঁটা যায়। অন্য দেশের নাগরিক হয়েও, আর্জেন্টিনার হওয়া যায়। মেসিকে নিজের লোক বলা যায়। তবে মেসি আসলে সত্যিই সত্যিই যাঁদের ঘরের লোক, সেই আর্জেন্টিনা থেকে কত মানুষ যে এসেছেন কাতারে নায়কের হাতে কাপ দেখার আকাঙ্ক্ষায় তা গুনে বলা কঠিন। গ্রেটা, অ্যাঞ্জেলিনা, ক্লদিয়ারা সেই ভিড়েরই অংশ। নীল–সাদা রঙে সেজে লুসেইল স্টেডিয়ামে পা রেখেছিলেন ওঁরা। তারপর মেসিময় হয়েই থেকে গেলেন। ম্যাচ চলাকালীন। ম্যাচ শেষের পরও। কখনও খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন, কখনও আনন্দাশ্রুতে ভাসলেন। কখনও একা একাই হাসলেন!‌ একে পাগলপারা না বলে কী–ই বা বলা যায়?‌ কিন্তু এমন পাগল–রাতের সুখানুভূতিই যে আলাদা। সেই সুখানুভূতি নিয়েই কাতারে উপস্থিত আর্জেন্টিনার সমর্থকরা রাত জাগলেন। ‘‌মেসি, মেসি’‌ ধ্বনিতে মুখর হল সুক ওয়াকিফ, অলবিদ্দা ফ্যান পার্ক, কাতারের মল। ভোরের মেট্রোতেও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের উপস্থিতি বেশি। ক্লান্ত শরীর, ঘুম জড়ানো চোখে নিজেদের ডেরায় ফিরছিলেন ওঁরা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বললেই, বেরিয়ে আসছিল দুটো শব্দ। ‘‌ভ্যামস’‌, ‘‌মেসি’‌। ওঁদের মনের খোলা চিঠি দিব্যি পড়া যাচ্ছিল তখন। মেসি ওই খোলা চিঠিটা অনেক আগেই কোন ছেলেবেলায় পড়েছিলেন। তাই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও পাহাড় প্রমাণ চাপ কাঁধে নিয়ে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। যন্ত্রের পৃথিবীতে শিল্পীর ধ্বজা হাতে বুঝিয়ে যান, এখনও সবাই যান্ত্রিক হয়নি। 

    স্থানীয় সময় গভীর রাতে কাতারের সড়কের দখল যখন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা নিয়েছিলেন, সেই সময় মেসি কী করছিলেন। ম্যাচ শেষে সাজঘরে ফিরে শান্ত স্বভাবটায় সাময়িক দাঁড়ি টেনেছিলেন। তারপর সতীর্থদের সঙ্গে নেচেছেন!‌ যেমন খুশি, যতক্ষণ খুশি। অনেকদিন পর এমন শিশুসুলভ আচরণ করলেন। সৌদি আরবের কাছে হারার পর বুকের ওপর যে চাপটা তৈরি হয়েছিল তা কাটতেই এতটা বাঁধনছাড়া তিনি। পরে সাংবাদিকদের সামনে যখন এলেন, তখন অবশ্য অধিনায়কসুলভ বক্তব্যই রাখলেন। বললেন, ‘‌পাহাড় প্রমাণ চাপটা ঘাড় থেকে নামল। শান্তি ফিরল। এবার সব কিছুই আমাদের হাতে। দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে খেলতে নেমেছিলাম। প্রথমার্ধে খেলাটা আশানুরূপ হয়নি। প্রতিপক্ষ অর্ধে জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঠিকঠাক মুভ হচ্ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যা যা করতে চেয়েছি, পেরেছি। প্রথম গোলের পর ম্যাচ হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল। বাকি ম্যাচেও এভাবেই খেলতে হবে। তবে পোল্যান্ড ম্যাচে অন্য পরিকল্পনা থাকবে। সেই পরিকল্পনা নিয়েই ঝাঁপাতে হবে।’‌ 

    ‘‌ভ্যামস আর্জেন্টিনা’‌, তিনি বললে কার সাধ্য তা উপেক্ষা করে?‌ প্রতিপক্ষ কোচেদের এরপর কি আর ঘুম আসবে?‌ 
  • Link to this news (আজকাল)