চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘গঙ্গা এবং তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হয়তো আপনার কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও মতামত না নিয়ে এমন একতরফা আলোচনা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়।’’ বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের সঙ্গে যে তিনি সুসম্পর্ক রাখতে চান, সেই বার্তা দিয়ে মমতা জানিয়েছেন, ছিটমহল বিনিময়, রেল ও বাস যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে।
কিন্তু এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘কিন্তু জল অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণধারণের রসদ নিয়ে কোনও সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই।’’ পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে জলবণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলেও অভিযোগ করেন তিনি। বস্তুত, সোমবার বিকেলে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে জলবণ্টন নিয়ে নয়াদিল্লি-ঢাকা দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মমতা। সেই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, ‘‘চিনকে দিয়ে ড্যাম (জলাধার) বানিয়েছে বাংলাদেশ।’’
প্রসঙ্গত, গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। এই আবহে শনিবার নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মধ্যে একটি বৈঠক হয়। সেখানে ‘ফরাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবীকরণের জন্য ‘যৌথ কারিগরি কমিটি’ তৈরি করা হয়েছে। কার্যত এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে জলবণ্টন চুক্তি নবীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হল। রবিবারই তৃণমূলের তরফে মোদী সরকারের ওই পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়েছিল।
১৯৯৬-এ যখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি হয়েছিল, সে সময় ঢাকায় এখনকার মতোই শেখ হাসিনার সরকার ছিল। দিল্লিতে ছিল এইচডি দেবগৌড়ার যুক্তফ্রণ্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সে সময় গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তিতে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিলেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার সে সময় রাজ্যকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিলেও মোদীর জমানায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অগ্রাহ্য করে রাজ্যকে পুরো প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যেই।
১৯৯৬ সালের চুক্তি মোতাবেক, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন ৪০ হাজার কিউসেক করে জল পায় ভারত। ফরাক্কা ব্যারাজ থেকে ফিডার ক্যানাল হয়ে কলকাতা বন্দরে যায় সেই জল। অবশিষ্ট জল মূল ব্যারেজ হয়ে যায় বাংলাদেশে। তবে মার্চ-এপ্রিলে নদীতে জল কমতে শুরু করলে সমস্যা বাড়ে। চুক্তি অনুযায়ী, মার্চ মাসে ২০ দিন বাংলাদেশে ৩৫ হাজার কিউসেক করে জল যায়। পরবর্তী ১০ দিন ভারত পায় একই পরিমাণ জল। এপ্রিলে উল্টো। ওই মাসে ভারত ২০ দিন পায় ৩৫ হাজার কিউসেক জল। বাংলাদেশ শেষ ১০ দিন পাবে একই পরিমাণ জল। বাকি সময় নদীতে যে জলপ্রবাহ থাকবে, তা সমান ভাবে পাবে দু’দেশ।
মোদীকে পাঠানো চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে গঙ্গার জলের গুরুত্বের পাশাপাশি ফরাক্কা থেকে পাওয়া জল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বড় ভরসা।’’ সেই সঙ্গে চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা, ‘‘ফরাক্কা ফিডার ক্যানালের মাধ্যমে অন্তত ৪০ হাজার কিউসেক জল পেলে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা সম্ভব।’’ তা না হলে গঙ্গায় পলি পড়ে কলকাতা বন্দর জাহাজ চলাচলের উপযোগী নাব্যতা হারাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
প্রায় আট বছর আগে ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে ঠিক ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাংশায় পদ্মা নদীর উপর হাসিনা সরকার বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগী হওয়ায় আপত্তি তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দু’দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত জলঙ্গি এবং মাথাভাঙা নদী ইতিমধ্যেই পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে বলে চিঠিতে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। লিখেছেন, ‘‘এর ফলে সুন্দরবনে মিষ্টি জলের প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।’’
প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে তিস্তার জলবণ্টন প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। লিখেছেন, ‘‘সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তার গুরুতর স্বাস্থ্যহানি হয়েছে। পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।’’ এর পরেই কেন্দ্রকে নিশানা করে চিঠিতে তাঁর মন্তব্য, ‘‘দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, তিস্তার ভারতীয় অংশের স্বাস্থ্য ফেরাতে জলশক্তি মন্ত্রকের কোনও উদ্যোগই নেই!’’ সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তায় জলপ্রবাহ কমেছে এবং তাতে উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়। ২০১১ সালে আর একটি তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি করে দুই দেশ, যেখানে শুখা মরসুমে ভারতের ৩৭.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৪২.৫ শতাংশ জল পাওয়ার কথা হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চুক্তির বিরোধিতা করেন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানির যুক্তি দেখিয়ে। যে হেতু ভারতের সংবিধান অনুযায়ী জলের উপর রাজ্যের অধিকার স্বীকৃত, তাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি উপেক্ষা করে তিস্তা চুক্তি রূপায়ণ কার্যত সম্ভব নয় কেন্দ্রের পক্ষে।