শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে কোন পক্ষ জিতবে, তা নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে। কিন্তু সংবিধান বলছে, বিধায়কদের শপথগ্রহণ নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্ব রাজ্যপালের। সেই ক্ষমতার বলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ওই দু’জনের শপথ নিয়ে ‘অনড় অবস্থান’ নিয়েছেন। গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই প্রকাশিত হয় বরাহনগর ও ভগবানগোলা বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল। বরাহনগর থেকে জয়ী হন তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী সায়ন্তিকা। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় জেতেন রায়াত। কিন্তু জুন মাসের শেষ সপ্তাহে এসেও বিধায়কপদে শপথ নেওয়া হয়নি তাঁদের। প্রতিবাদে তাঁরা লাগাতার ধর্না অবস্থান করছেন বিধানসভায়।
নিয়ম অনুযায়ী, আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর থেকে দু’টি পৃথক চিঠি পাঠানো হয় বিধানসভা এবং রাজ্য সরকারের কাছে। ওই চিঠিতে জয়ীদের সম্পর্কে তথ্য জানানো হয় দু’পক্ষকে। এর পরেই সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের পরিষদীয় দফতর রাজভবনকে চিঠি দিয়ে জয়ীদের শপথগ্রহণের বিষয়ে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করে। সেই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। গোল বেধেছে তার পরেই। নিয়ম অনুযায়ী, এর পরে রাজ্যপাল স্পিকারকে শপথগ্রহণ করানোর দায়িত্ব দিতে পারেন। রাজ্যপাল যদি চান, তিনি নিজেও বিধায়কদের শপথগ্রহণ করাতে পারেন। নতুবা তাঁর ‘মনোনীত’ কেউ বিধায়কদের শপথগ্রহণ করাতে পারেন। এই দু’জনের ক্ষেত্রে পরিষদীয় দফতর রাজভবনকে চিঠি দেয়নি। তার বদলে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় রাজভবনকে চিঠি দিয়ে দুই বিধায়কের নির্বাচিত হওয়ার কথা জানিয়ে তাঁদের শপথগ্রহণ করানোর কথা বলেন। এর পর রাজভবনের তরফে আলাদা আলাদা করে সায়ন্তিকা ও রায়াতকে চিঠি দিয়ে গত বুধবার দুপুরে রাজভবনে গিয়ে শপথগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু দু’জনেই পাল্টা রাজভবনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন, তাঁরা রাজভবন নয়, বিধানসভায় শপথগ্রহণ করতে চান। চাইলে রাজ্যপাল বিধানসভায় এসে তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করাতে পারেন। বুধবার বিধায়কেরা রাজভবনে না গিয়ে বিধানসভায় ধর্না অবস্থান শুরু করেন। ওই দিনই দুপুরের বিমানে রাজ্যপাল দিল্লি যান। ফলে ঝুলে রয়েছে শপথগ্রহণ।
প্রসঙ্গত, স্পিকার যদি নিজের ক্ষমতাবলে দু’জনকে শপথগ্রহণ করিয়ে বিধানসভা অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দেন, তা হলে সংবিধানের ১৯৩ ধারা অনুযায়ী বিধায়কেরা যে ক’দিন বিধানসভার অধিবেশনে যোগদান করবেন, সেই দিনগুলির জন্য প্রত্যেককে প্রতি দিন ৫০০ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। স্পিকারের চিঠি পেয়ে নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে বিধায়কদের শপথগ্রহণ সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম ও আইনকানুনের বিষয় উল্লেখ করে জরিমানার কথাটিও জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল। যদিও বুধবার স্পিকার বিমান বলেছেন, ‘‘অম্বেডকর বলেছিলেন, উপনির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিকে স্পিকার শপথগ্রহণ করাতে পারেন। তাই এ বিষয়ে আমরা আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে আমরা রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হব।’’ তার পরেই বুধবার বিকালে বিধানসভায় স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক করতে আসেন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক।
আইন অবশ্য বলছে, বিধায়কদের শপথগ্রহণের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভরশীল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপালের সিদ্ধান্তের উপর। যে ক্ষমতাবলে ভবানীপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে জয়ী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শপথগ্রহণ করিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। তিনি অবশ্য বিধানসভায় এসে মুখ্যমন্ত্রীকে শপথগ্রহণ করিয়েছিলেন। গত বছর ধুপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনের পরেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। উপনির্বাচনে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায়ের শপথগ্রহণ দীর্ঘ দিন আটকে থাকার পর রাজভবনে তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল বোস। ২০২২ সালের এপ্রিলে বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। সে ক্ষেত্রে তৎকালীন রাজ্যপাল শপথগ্রহণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। কিন্তু আশিস সেই দায়িত্ব পালনে ‘অক্ষম’ বলে জানালে রাজ্যপাল সিদ্ধান্ত বদল করে বাবুলের শপথের দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্পিকারকে। এমন সমস্ত উদাহরণ সামনে রেখে শাসকদলের একাংশ মনে করছে, রাজ্যপাল ‘নমনীয়’ হলে সমস্যা মিটে যাবে। নচেৎ বিষয়টি আদালতে যাবে। সে ফয়সালা হওয়া পর্যন্ত আটকে থাকবে সায়ন্তিকা, রায়াতের শপথগ্রহণ।