আরজি করের ঘটনায় হাই কোর্টের নির্দেশে ‘স্বস্তি’ হল না ‘অস্বস্তি’? যুক্তি এবং প্রতিযুক্তির জল্পনা তৃণমূলে
আনন্দবাজার | ১৩ আগস্ট ২০২৪
আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় কলকাতা হাই কোর্টের সিবিআই তদন্তের নির্দেশে কি আসলে ‘স্বস্তি’ই দিল শাসক তৃণমূলকে? দলের একটি অংশ তেমনই মনে করছে। কিন্তু অন্য একটি অংশ মনে করছে, হাই কোর্টের নির্দেশের মধ্যে একই সঙ্গে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ‘অসন্তোষ’ এবং আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে নিয়ে ‘কড়া পর্যবেক্ষণ’ও রয়েছে। অতএব এতে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তিই বেশি।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই বলছিলেন, রাজ্য সরকারের উপর আস্থা না-থাকলে মৃতার পরিবার চাইলে সিবিআই বা অন্য কোনও এজেন্সির কাছে তদন্তের জন্য যেতে পারে। তাতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। সোমবার তিনি বলেছিলেন, আগামী রবিবার পর্যন্ত তিনি কলকাতা পুলিশকে সময় দিচ্ছেন। তার মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি না-হলে তিনি সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের ভার তুলে দেবেন। তার ২৪ ঘন্টার মধ্যে কলকাতা হাই কোর্ট কলকাতা পুলিশের হাত থেকে ওই ঘটনার তদন্তভার নিয়ে সিবিআইকে দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে হাই কোর্টের নির্দেশের মধ্যে ছিল সন্দীপ ঘোষকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করে ‘পুরষ্কৃত’ করার বিষয়টিও। আদালত তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে এবং স্পষ্ট বলেছে, সন্দীপকে এখনই কোথাও অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা যাবে না।
তবে তৃণমূলের যে অংশ সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে ‘স্বস্তি’ হিসাবে দেখতে চাইছেন, তাঁরা নিজেদের মতো করে যুক্তি দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, হাই কোর্টের এই রায়ে ‘শাপে বর’ হয়েছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘রবিবারের মধ্যে যদি পুলিশ কাউকে ধরতে না পারত, তা হলে অভিযোগ উঠত। দু’জনকে ধরলে বলা হত, আরও লোক রয়েছে। সে দিক থেকে এ বার পুরোটাই সিবিআই করবে। রাজ্যের ঘাড়ে আর কিছু রইল না।’’ প্রসঙ্গত, একই অভিমত প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরীরও। তিনি বলেছেন, ‘‘এ বার তো দিদিমণি বলতে পারবেন, যা করার সিবিআই করবে। তাঁর ঘাড়ে আর কিছু রইল না।’’ তৃণমূলের এক বিধায়কের আবার আশা, ‘‘এ বার গোটাটাই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে। তাই রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চিকিৎসকেরা কর্মবিরতি চালিয়ে গেলে জনমানসে তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হবে। রাজ্যও সুযোগ পাবে জরুরি পরিষেবা সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করার।’’ ওই নেতা এ-ও বলেন, ‘‘ক্ষোভ এখন টাটকা বলে অন্য একটি বিষয় আড়ালে চলে যাচ্ছে। তা হল, কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় হাসপাতালগুলিতে রোগীদের দুর্ভোগ। চিকিৎসা না পেয়ে কারও কারও মৃত্যুও হচ্ছে। কিন্তু এটা বেশি দিন চলতে পারে না।’’
প্রকাশ্যে অবশ্য সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির সাফল্যের হার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূল নেতারা। দলের মুখপাত্র শান্তনু সেন তাপসী মালিককের ধর্ষণ এবং খুন, রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যু, রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি-সহ একাধিক ঘটনা তুলে প্রশ্ন ছুড়েছেন, সিবিআই কী করল? পাল্টা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘‘সারদা এবং রোজভ্যালি বাদ দিলে নেতাইকান্ড, নন্দীগ্রামে জননী ইটভাটায় ধর্ষণ-সহ একাধিক ঘটনায় সিবিআইয়ের তদন্তের পর গ্রেফতার সাজা হয়েছে।’’
তবে পাশাপাশিই তৃণমূলের অন্দরে একাংশ মনে করছএন, হাই কোর্টের রায়ে ‘অস্বস্তি’ পাওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই তদন্তের কথা বলেছিলেন। আদালত সেই নির্দেশই দিয়েছে। কিন্তু সকালে ইস্তফা দেওয়া সন্দীপকে রাজ্য সরকারই বিকেলে অন্য মেডিক্যাল কলেজে নিয়োগ দিয়েছে। যিনি সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন, যিনি বিতর্কে জড়িয়ে, তাঁকে অব্যাহতি না দিয়ে উল্টে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যা খারিজ করে দিয়েছে আদালত। যা রাজ্য সরকার তথা দলের কাছেও বিড়ম্বনার।’’
ওই মন্ত্রীর এ-ও বক্তব্য যে, সন্দীপকে নতুন নিয়োগ না দিলে হাই কোর্ট মঙ্গলবারেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিত কি না, সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘সন্দীপকে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ করে পাঠানো থেকে গোটা ঘটনায় রাজ্য সরকারের মনোভাব সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ ধারণা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। সে কারণেই এই নির্দেশ।’’
প্রসঙ্গত, আরজি কর-কাণ্ডে গোড়া থেকেই মমতা ছিলেন ‘নমনীয় এবং সহানুভূতিশীল’। যাকে তৃণমূলও রাজনৈতিক ভাবে ‘ইতিবাচক’ মনে করছিল। কিন্তু সন্দীপের নিয়োগকে শাসকদলের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় ‘এক বালতি দুধে এক ড্রাম চোনা’ বলে অভিহিত করছেন। তৃণমূলের একটি অংশ মনে করছে সন্দীপকে ‘পুরষ্কৃত’ করার বিষয়টি আদালতের রায়কে ‘প্রভাবিত’ করে থাকতে পারে। গোটা ঘটনায় যে ‘নাগরিক ক্ষোভ’ তৈরি হয়েছে, তা যে তাঁদের জন্য ‘শুভ ইঙ্গিত’ নয়, তা মানছেন অংশ-নির্বিশেষে তৃণমূলের নেতারা।