আর জি কর মেডিক্যালের তরুণী-চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল মহানগর। সেই ঢেউ লেগেছে গ্রামাঞ্চলেও। স্কুল-কলেজের ছাত্রী থেকে বধূ, কর্মরত মহিলারা পথে নেমেছেন। মিছিল থেকে স্লোগান উঠছে— ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার আছে, লক্ষ্মীর নিরাপত্তা নেই’। তবে কি তৃণমূলের লোকসভা ভোটে জেতার অন্যতম শক্ত ‘হাতিয়ার’ লক্ষ্মীর ভান্ডার কি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে? চর্চা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
১৪ অগস্ট মধ্যরাতে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া শহর থেকে দু’জেলার মফস্সল এলাকায় মহিলা ও পুরুষ জমায়েত করে প্রতিবাদে উত্তাল হন। তারপর থেকে রোজই কোথাও না কোথাও প্রতিবাদ মিছিল, জমায়েত হচ্ছে। তা দেখে কিছুটা হলেও চিন্তিত শাসকশিবির। এর মধ্যেই কোথাও কোথাও লক্ষ্মীর ভান্ডার ও কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা বর্জনের ডাক কিছুটা হলেও ভাবাচ্ছে তাঁদের। যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব প্রকাশ্যে দাবি করছেন, উদ্বেগের কিছু নেই।
লোকসভা ভোটে পুরুলিয়ায় এ বারও তৃণমূল পরাজিত হয়েছে। মূলত শহর ও ব্লক সদর শাসকদল থেকে মুখ ফিরিয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অযোধ্যাপাহাড়তলির গ্রামাঞ্চলেও লক্ষ্মীর ভান্ডার বর্জনের স্লোগান শোনা গিয়েছে। সোমবার আড়শার সিরকাবাদে মিছিলে ছাত্রী ও মহিলাদের মধ্যে থেকে স্লোগান ওঠে, ‘কন্যাশ্রী চাই না, চাই নারীর সুরক্ষা’, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার চাই না, চাই নারীর সুরক্ষা’।
আড়শার এক স্কুল ছাত্রীর কথায়, ‘‘আমরা কন্যাশ্রী, এটা আমাদের গর্ব। কিন্তু আর জি কর মেডিক্যালের ভিতরে এ ভাবে একটি মেয়েকে খুন হতে হবে, মেনে নেওয়া যায় না। মেয়েদের নিরাপত্তা না থাকলে কী হবে কন্যাশ্রীর সহায়তায়?’’ মিছিলে থাকা এক বধূর কথায়, ‘‘আমরা কি রাতের বেলায় বেরোতে পারব না? এই প্রশ্ন নিয়েই আমরা পথে নেমেছি।’’
নিরাপত্তার দাবিতে পথে নামা ঝালদা গার্লস হাই স্কুলের কন্যাশ্রী ক্লাবের ‘বড়দি’ সুভদ্রা মাহাতো ও রিম্পা সিংহের কথায়, ‘‘আ জি করের ঘটনা আমাদের মধ্যে প্রচণ্ড কষ্টের অনুভূতি তৈরি করেছে। আমরা কন্যাশ্রী, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? আজ কলকাতায় যা ঘটেছে, কাল ঝালদায় তা ঘটবে না কে বলতে পারে?’’ ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অপর্ণা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের দাবি মেনে আমরাও ওদের সঙ্গে পথে নেমেছিলাম।’’
এ নিয়ে তৃণমূলের কিছু নেতা তীর্যক মন্তব্য শুরু করায় প্রতিবাদও শোনা যাচ্ছে। পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদনপত্র পোস্ট করা হয়েছে। দলেরই কেউ কেউ আড়ালে বলছেন, কেউ চাইলে প্রতিবাদ জানাতে এই প্রকল্প থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। ওই পোস্ট ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
পুরুলিয়া সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সৌমী ধর সরাসরি বলছেন, ‘‘সরকারি প্রকল্পের সহায়তা পাচ্ছি বলে মেয়েদের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়লে প্রতিবাদ করা যাবে না, এটা হতে পারে না।’’ একই প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা বিভাগের ছাত্রী সুইটি গঙ্গোপাধ্যায়ও।
যদিও পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়ার দাবি, ‘‘এমন কোনও পোস্ট আমি দেখিনি। কে, কী বলছেন জানি না। তবে এমন কোন পোস্ট দল সমর্থন করে না। সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরাও ওই ঘটনায় দোষীর কড়া সাজা চাইছি।’’
১৪ অগস্ট রাতে বাঁকুড়া শহরেও লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প বর্জনের স্লোগান শোনা গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই স্লোগান দিয়েছিলেন বামপন্থী মহিলারা। মঙ্গলবার বাঁকুড়া পুরসভায় এক বধূ তাঁর মেয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডারের আবেদনে কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য গিয়েছিলেন। তখন এক তৃণমূল পুর-প্রতিনিধি মজা করেই তাঁকে বলেন, “অনেকেই লক্ষ্মীর ভান্ডার নেবেন না বলছেন। আর আপনি এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে এসেছেন?” ওই বধূর স্পষ্ট জবাব, “লক্ষ্মীর ভান্ডার সরকারি প্রকল্প, কোনও দলের নয়। আর জি কর নিয়ে আন্দোলন নারী সুরক্ষার দাবি। তার সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের কোনও যোগ নেই।” ছাতনার বধূ চম্পা বাউরি জানান, মহিলা ডাক্তারকে খুন, নির্যাতনের বিচার তো চাইবেন। তা বলে লক্ষ্মীর ভান্ডার নেবেন না কেন? বাঁকুড়া শহরের বধূ সঙ্গীতা নাগ বলেন, “সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডার দেবে বলে মেয়েদের নিরাপত্তা দেবে না, এমন কোনও শর্ত তো রাখা হয়নি। তাহলে কেন প্রশ্ন উঠবে? যদি এমন শর্ত থাকত তখন ভাবতাম লক্ষ্মীর ভান্ডার নেব কি না।”
যদিও তৃণমূলের বাঁকুড়া সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা বাঁকুড়ার সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কন্যাশ্রী ও লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলাদের সম্মান দিচ্ছেন। তা সহ্য হচ্ছে না বলে বিরোধীরা উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’’