আরজি কর-কাণ্ডে ‘খটকা’ লাগছে সুপ্রিম কোর্টের। গত ৯ অগস্ট ভোরে চিকিৎসক খুনের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকে ওই দিন রাতে ঘটনাস্থল সিল করা পর্যন্ত যে ঘটনাপরম্পরা আদালতে পেশ করা হয়েছে, তাতেই বেড়েছে সেই ‘খটকা’। বিচারপতিরা সময় ধরে ধরে জানতে চেয়েছেন তাঁদের মনে হওয়া গরমিলগুলির ব্যাখ্যা কী? উত্তর জেনেও শেষ পর্যন্ত সন্তুষ্ট হতে পারেনি সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি পারদিওয়ালা শুনানির এক পর্যায়ে বলেন, ‘‘অবাক হচ্ছি, ময়নাতদন্তের আগেই বলে দেওয়া হল অস্বাভাবিক মৃত্যু? এটা কী ভাবে সম্ভব? তা হলে ময়না তদন্তের প্রয়োজনই কী ছিল?” আবার পরে এ বিষয়ে রাজ্যের সংশোধিত ব্যাখ্যা শুনে তিনিই বলেছেন, ‘‘ময়নাতদন্তের পরই বা অস্বাভাবিক মৃত্যু বলা হয় কী করে? তখন তো মৃত্যুর কারণ জেনেই গিয়েছে পুলিশ!’’
আরজি করে চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় সিবিআইয়ের কাছে তদন্ত রিপোর্ট চেয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার সেই রিপোর্ট জমা দিয়ে সিবিআই আদালতকে বলে, ‘‘ঘটনার পাঁচ দিন পরে তদন্ত করতে নেমেছে তারা। তবে তত দিনে সব কিছু বদলে গিয়েছে।’’ যদিও রাজ্য সিবিআইয়ের দাবিকে নস্যাৎ করে বলে, তাদের কাছে ঘটনার সম্পূর্ণ ‘টাইমলাইন’ রয়েছে। রয়েছে ‘ভিডিয়োগ্রাফি’ও। তাই সিবিআই যে দাবি করছে, তা সত্য নয়। রাজ্যের আইনজীবীর দাবি, কিছুই বদলে যায়নি। রাজ্যের তরফে আদালতে হাজির ছিলেন আইনজীবী কপিল সিব্বল। অন্য দিকে, সিবিআইয়ের তরফে সওয়াল করছিলেন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা। এই দুই আইনজীবীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার আরজি করের ঘটনা পরম্পরা নিয়ে তর্ক চলেছে সুপ্রিম কোর্টে। তিন বিচারপতি বার বার প্রশ্ন তুলেছেন, ঘটনা পরম্পরার সত্যাসত্য নিয়ে।
বৃহস্পতিবার আরজি কর মামলার শুনানি ছিল প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে। সেখানেই রাজ্যের দেওয়া ‘টাইমলাইন’ নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তোলেন সলিসিটার জেনারেল মেহতা। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসকের দেহ সৎকারের পরে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআর করা হয়েছে। এটা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে।’’
জবাবে রাজ্যের আইনজীবী সিব্বল: কী কী হয়েছে প্রতি মিনিটের টাইমলাইন আমাদের কাছে রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি: ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখান। (রিপোর্ট দেখার পরে) একটা জিনিস নিয়ে খটকা লাগছে। সকাল ১০:১০ মিনিট নাগাদ টালা থানা জেনারেল ডায়েরি করল। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ঘটনাস্থল সিল করল পুলিশ? তত ক্ষণ সেখানে কী হচ্ছিল?
বিচারপতি মিশ্র: ৯ অগস্ট সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত হয়। সাড়ে ১১টায় জেনারেল ডায়েরিতে লেখা হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা।
রাজ্য: না না। বিষয়টা এমন নয়। পুলিশ যখন থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান (ইনকুয়েস্ট) শুরু করে, তখন থেকেই ভিডিয়োগ্রাফি রয়েছে।
সিবিআইয়ের আইনজীবী সলিসিটর জেনারেল মেহতা: প্রথমে পরিবারকে বলা হয় আত্মহত্যা। পরে বলা হয় মৃত্যু। তখন সন্দেহ তৈরি হতে তার পরে থেকে ভিডিওগ্রাফি করা হয়।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: কখন ময়নাতদন্ত হয়েছিল?
রাজ্য: সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ কখন দায়ের করলেন?
রাজ্য: রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: এটা কি অস্বাভাবিক মৃত্যু? যদি তা-ই হয়, তবে ময়নাতদন্তের কী প্রয়োজন ছিল? এখানে তো দেখতে পাচ্ছি রাত ১১:৩০ অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ দায়ের হয়। আর তার ১৫ মিনিটের মাথায় এফআইআর দায়ের হয়ে গেল? আদালতের কাছে সঠিক তথ্য দিন।
রাজ্য: (নীরব)।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: অবাক হচ্ছি, ময়নাতদন্তের আগেই বলে দিল অস্বাভাবিক মৃত্যু? এ ভাবে নিজেদের বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করবেন না। পরের বার শুনানিতে কোনও দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারকে এখানে রাখবেন। পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার কে? তদন্তে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ রয়েছ। কী ভাবে এমন তদন্ত হল?
প্রধান বিচারপতি: এখানে স্পষ্ট লেখা করে রয়েছে রাত ১১:৩০ মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল।
রাজ্য: জেনারেল ডায়েরিতে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লেখা হয়।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: এত সময় নিলেন কেন? তদন্তের কাজ কখন শুরু হয়েছিল?
রাজ্য: দুপুর ৩টে ৪৫ মিনিট।
বিচারপতি পারদিওয়ালা: আমি আমার ৩০ বছরের আইনের কেরিয়ারে এমন ভাবে তদন্ত হতে দেখিনি। আপনি যদি ময়নাতদন্তের আগে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করেন, তবে কিসের ভিত্তিতে করলেন। যদি ময়নাতদন্তের পরে অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করে থাকেন, তবে তখন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা কেন দায়ের করলেন, তখন তো মৃত্যুর কারণ জেনেই গিয়েছেন!
প্রধান বিচারপতি: আপনারা বলছেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল ৯ অগস্ট দুপুর ১ টা ৪৫ মিনিটে। অথচ কেস ডায়েরিতে স্পষ্ট বলা আছে, রাত ১১টা ৩০ মিনিটে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের হয়েছিল। কোনটি ঠিক?
রাজ্য: ঘটনাস্থল সিল করা, প্রাথমিক তদন্ত, অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা দায়ের সবই হয়েছে ১১টার আগে।
প্রধান বিচারপতি: কেসডায়েরিতে দেখেছি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট— সবই নথিভুক্ত হয়েছে সাড়ে ১১টার সময়।
সলিসিটর জেনারেল: প্রথমে জেনারেল ডায়েরি হয়। তার পরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয় সাড়ে ১১টার সময়। তার পরে ১১টা ৪৫ মিনিটে এফআইআর হয়।
বিচারপতি মিশ্র: থানায় জেনারেল ডায়েরি হয়। ঘটনাস্থলেই কেস ডায়েরি আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিযোগ দায়ের হয় সাড়ে ১০টার সময়। এটা কি ঠিক?
রাজ্য: ঠিক।
(বিরতির পরে )প্রধান বিচারপতি: সকাল সাড়ে ৯টায় দেহ উদ্ধার হয়। আর রাত সাড়ে ১১টায় এফআইআর দায়ের হয়। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে এফআইআর! এটার কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। কেন ১৪ ঘণ্টা দেরিতে এফআইআর দায়ের হল? কেন অধ্যক্ষ এফআইআর দায়ের করতে এলেন না? তাঁকে কি কেউ বাধা দিচ্ছিল? কেন তাঁকে বদলি করে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হল? এই সবের কারণ জানতে চায় আদালত।
এর পরেই আরজি করের ঘটনা নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন বিচারপতি। তবে আরজি কর-কাণ্ডের ঘটনা পরম্পরার সময় নিয়ে ‘খটকা’ দূর হয়নি তার পরেও। সলিসিটার জেনারেল বলেন, ‘‘আমরা পাঁচ দিন পরে তদন্ত শুরু করেছি। তত দিন অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।’’ রাজ্য যদিও এই অভিযোগ খারিজ করেছে। তাদের দাবি ঘটনার ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছে।