রাজ্য জুড়ে পূর্ণ কর্মবিরতি শুরু জুনিয়র ডাক্তারদের, টানা আট ঘণ্টা জিবি বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত
আনন্দবাজার | ০১ অক্টোবর ২০২৪
আরজি কর-কাণ্ডে নির্যাতিতার বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা-সহ একাধিক অভিযোগ তুলে ফের পূর্ণ কর্মবিরতির পথে হাঁটলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে শুরু হয়ে গেল জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি। জুনিয়র ডাক্তারদের সকলে তাকিয়ে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টে সোমবারের আরজি কর মামলার শুনানির দিকে। গত শনিবারের জিবি বৈঠকের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন, রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে পূর্ণ কর্মবিরতি করবেন তাঁরা। সোমবার গভীর রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত চলা দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার জিবি বৈঠকের পর সেই পথেই হাঁটলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। চিকিৎসকদের তরফ থেকে মোট দশ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে। সেই দাবিগুলি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
জিবি বৈঠক শেষে চিকিৎসকদের দাবি, রাজ্যের তরফ থেকে বার বার নিরাপত্তার আশ্বাস মিলেছে। কিন্তু তা সুনিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা তারই উদাহরণ। তাই এই সিদ্ধান্ত। ডাক্তারদের তরফ থেকে যে দশ দফা দাবি পেশ করা হয়েছে সেগুলি হল— নির্যাতিতার দ্রুত ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ, হাসপাতালগুলিতে পুলিশি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা, সমস্ত সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় রেফারেল ব্যবস্থা চালু করা, হাসপাতালের খালি বেডের মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, হাসপাতালগুলিতে শূন্যপদ পূরণ করা, হুমকি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা, দ্রুত সমস্ত হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজে টাস্ক ফোর্স গঠন করে সিসিটিভি, প্যানিক বোতামের ব্যবস্থা করা। এই সব দাবি নিয়েই এ বার পূর্ণ কর্মবিরতিতে ডাক্তারেরা।
সোমবার দেশের শীর্ষ আদালতে শুনানি চলাকালীন ‘প্রভাবশালী’ তত্ত্ব উঠে আসে। পাশাপাশি, তদন্তের আওতায় আসা হাসপাতালের সাত জনকে আপাতত সাসপেন্ড (নিলম্বিত) করারও দাবি জানান জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। কারা তদন্তের অধীনে রয়েছেন সেই নামের তালিকা আদালতে জমা দেওয়ার জন্য সিবিআইকে নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তখন রাজ্যের আইনজীবী জানান, পাঁচ জনকে ইতিমধ্যে নিলম্বিত করা হয়েছে। কোন পাঁচ জনকে নিলম্বিত করা হয়েছে, সেই নামের তালিকাও জানতে চান প্রধান বিচারপতি। রাজ্যের তরফেও আদালতে আশ্বস্ত করা হয়, তদন্তকারী সংস্থা নামের তালিকা দিলে পদক্ষেপ করা হবে। রাজ্যের আইনজীবী জানান, কেউ যত প্রভাবশালীই হোন, সিবিআই তাঁদের নামের তালিকা দিলে পদক্ষেপ করা হবে।
রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ কত দূর এগোল, সেই প্রশ্নও করেছেন প্রধান বিচারপতি। এ নিয়ে রাজ্যের জবাব পাওয়ার পরে সরকারি হাসপাতালগুলিতে নিরাপত্তা এবং পরিকাঠামো সংক্রান্ত কাজ শেষ করার সময়সীমাও বেঁধে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আদালত জানিয়ে দেয়, আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে হাসপাতালগুলিতে সিসি ক্যামেরা বসানো-সহ সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে।
জুনিয়র ডাক্তারেরা কেন সব পরিষেবার কাজ করছেন না, সেই প্রশ্নও তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্যের তরফে জানানো হয়, জুনিয়র ডাক্তারেরা শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা দিচ্ছেন। বহির্বিভাগ ও অন্য ক্ষেত্রে পরিষেবা দিচ্ছেন না তাঁরা। যদিও তাতে আপত্তি জানান জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। তিনি দাবি করেন, প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। তখন প্রধান বিচারপতি জানতে চান, কেন শুধু প্রয়োজনীয় পরিষেবা কথা বলা হচ্ছে? তা হলে কি সকল চিকিৎসক সব ডিউটি করছেন না? ইন্দিরা জানান, জুনিয়র ডাক্তারেরা জরুরি পরিষেবায় রয়েছেন। জরুরি পরিষেবার মধ্যে ওপিডি ও আইপিডি— উভয়ই পড়ে। এর পরেই প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও অন্য ক্ষেত্রগুলি-সহ সমস্ত প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেবেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। আরও কিছু সওয়াল-জবাবের পর সোমবারের শুনানি শেষ হয়ে যায়।
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়াও কি আর কেউ জড়িত? যদি অন্য কেউ জড়িতই থাকেন, তবে তাঁদের কবে গ্রেফতার করা হবে? কেন খুন করা হয়েছিল ওই চিকিৎসককে? সিবিআইয়ের থেকে এখন এই প্রশ্নেরই উত্তর পেতে চাইছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। আর সেই প্রত্যাশা নিয়েই তাঁরা তাকিয়ে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টে মামলার শুনানির দিকে। অপেক্ষায় ছিলেন, শুনানিতে সিবিআই কী জবাব দেয় জানার জন্য। একই ভাবে রাজ্যের বক্তব্য শুনতেও মুখিয়ে ছিলেন আন্দোলনকারীরা। আরজি কর হাসপাতালে নির্যাতনের বিচারের দাবি তোলার পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তা, ভয়শূন্য পরিবেশ তৈরির দাবিতেও প্রতিবাদ করছেন তাঁরা। রাজ্যের হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজে তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্য কী পদক্ষেপ করেছে, তার সুনির্দিষ্ট উত্তর জানতে চাইছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এর মধ্যে কিছু প্রশ্নের উত্তর মিললেও বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই মেলেনি সোমবারের শুনানিতে।
এই মামলায় এখনও পর্যন্ত ৪২টি পক্ষ রয়েছে। তাদের হয়ে দাঁড়িয়েছেন ২০০-র বেশি আইনজীবী। তার মধ্যে রয়েছে অন্যতম প্রধান ন’টি পক্ষ। পুজো শেষে আবার এই মামলা শুনবে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। আগামী ১৪ অক্টোবর এই মামলার ফের শুনানি সুপ্রিম কোর্টে।