এক চিকিৎসকের মৃত্যু। ‘এক ডক্টর কি মওত’। আবারও। এই শহরেই। পুজোর কলকাতার চেনা ছবিটা তাই দুর্গার কাছে এই মুহূর্তে অনেকটাই এলোমেলো। উৎসবের শহর, না কি এক নৃশংস খুনের জেরে উত্তাল শহর? ঠিক কোন পরিচয়ে কলকাতাকে দেখবেন, গুলিয়ে গিয়েছে মুম্বই প্রবাসী দুর্গা ওরফে কানুপ্রিয়া দিদওয়ানিয়ার কাছে, যাঁর শিকড় বরাবরের জন্য এই শহরেই বাঁধা।
এক চিকিৎসক, যিনি আক্ষরিক অর্থেই দুর্গার সৃষ্টিকর্তা, নানা প্রতিকূলতা, ঈর্ষা, বিরোধিতার সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার রাস্তা বেছেছিলেন। আর এক চিকিৎসক, যিনি কর্মব্যস্ত দিনের শেষে একটু জিরোনোর সময়ে তাঁর কাজের জায়গাতেই খুন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুর্গার কাছে এঁরা দু’জনেই কোথাও একটা মিলে যাচ্ছেন। আর তখনই নিজের জন্মের ইতিহাস আর বর্তমান সময় এক হয়ে যাচ্ছে তাঁর কাছে। “নিজেদের লোভ, হতাশা, নিজেদের অন্যায় প্রকাশ হয়ে পড়ার আতঙ্ক এতটাই নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছিল কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, যে তারা অন্য মানুষটার জীবনকে নরক করে তুলতে চেয়েছিল। অন্য মানুষটার উপস্থিতি তাদের অস্বস্তিতে ফেলছিল বার বার। দুই ক্ষেত্রেই এক জন সৎ, বলিষ্ঠ ডাক্তারকে চলে যেতে হয়েছে এই সব মানুষের জন্যই। আমি এই অসুরদের বিনাশ চাই। বরাবরের জন্য।” ফোনে প্রত্যয়ী শোনায় রক্ত-মাংসের দুর্গার গলা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর বৃত্তান্ত তিনি বড় হয়ে জেনেছেন। কিন্তু আর জি করের চিকিৎসক-পড়ুয়ার মৃত্যু তাঁর সময়েরই ক্ষত। দুর্গার কথায়, “শুধু কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, গোটা পৃথিবীর লজ্জা এই দুটো ঘটনাই।”
ভারতের প্রথম ‘টেস্টটিউব বেবি’ দুর্গার জন্ম ১৯৭৮ সালে। এই অক্টোবর মাসেই, দুর্গাপুজোর সময়ে। এখন যতই তাঁকে নিয়ে স্বীকৃতির বন্যা বয়ে যাক না কেন, সেই সময়ে দুর্গার সৃষ্টিকর্তা চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায় সরকারি তরফে এবং নিজের পেশার মানুষের কাছ থেকে দিনের পর দিন মিথ্যা অভিযোগে জর্জরিত হয়েছিলেন। প্রতি পদে অপমানিত হতেন তিনি। দেশের প্রথম নলজাতকের জন্ম দেওয়ার দাবিকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে বার বার। লড়তে লড়তে ক্লান্ত সুভাষ ১৯৮১ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর চরিত্রের আদলে ‘অভিমন্যু’ উপন্যাস লিখেছিলেন রমাপদ চৌধুরী। যে উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি হয় তপন সিংহের ছবি ‘এক ডক্টর কি মওত’।
দুর্গা বলেন, “কাগজে-কলমে এটা আত্মহত্যা, কিন্তু আসলে এটাও একটা খুন। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষকে অনেকেই সহ্য করতে পারে না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ওই পথ বেছে নেওয়ার জন্য কার্যত বাধ্য করা হয়েছিল। আর এই মহিলা ডাক্তারও হয়তো নিজের চারপাশের মানুষের থেকে আলাদা ছিলেন বলেই তাঁকে এ ভাবে সরিয়ে দেওয়া হল। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে না পারলে এই ভাবেই পথ আটকে দেওয়া হয়। বার বার।”
কলকাতার আগরওয়াল দম্পতির কন্যা কানুপ্রিয়া ওরফে দুর্গা ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত কলকাতাতেই থেকেছেন। কলকাতার পুজো ঘিরে তাঁর অজস্র স্মৃতি। স্বামী এবং ১১ বছরের মেয়েকে নিয়ে অধুনা মুম্বই প্রবাসী, সফল চাকরিজীবী দুর্গা পুজোর সময়ে কলকাতায় আসার চেষ্টা করেন। বাংলা বুঝতে পারা এবং ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতে পারা দুর্গার কথায়, “কলকাতা সব সময়েই আমার নিজের শহর। দুর্গা মা আমার কাছেও সমস্ত অন্যায়ের বিনাশের প্রতীক। আমার নামটাই আসলে আমাকে অনেকটা শক্তি জোগায়। আমি নিজেকে ক্রমাগত বলতে থাকি, আমি যেন কখনও কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করি। আমি আপস করলে শুধু আমার বাবা-মা, আমার আপনজনেদের নয়, আমার সৃষ্টিকর্তা ওই আপসহীন ডাক্তারকেও অসম্মান করা হবে।” যত দিন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী নমিতা বেঁচেছিলেন, দুর্গা কলকাতায় এসে দেখা করতেন তাঁর সঙ্গে। “ওই মানুষটা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার মেয়েকেও নিয়ে গেছি ওঁর কাছে।”
এ বার পুজোয় কলকাতায় থাকবেন? দুর্গা বলেন, “নিশ্চিত নই। চেষ্টা করব।” এ বারের এই অনিশ্চয়তা কি বর্তমান পরিস্থিতির জন্য? এই প্রতিবাদমুখর শহরে আসতে চান না? বললেন, “তা একেবারেই নয়। তবে আমার কাছে প্রতিবাদের পথটা অন্য। শুধু রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ নয়, আমি ভিতরের পরিবর্তন নিয়ে বেশি ভাবি। আমরা আমাদের সন্তানকে ঠিক ভাবে বড় করছি কি? রাতারাতি কেউ ধর্ষক বা খুনি হয় না। বড় হয়ে ওঠার শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরি। আমরা কি সেটা নিয়ে ভাবি? মেয়েদের রাতে কাজ করার অধিকার নিয়ে এখন আমরা সরব হচ্ছি। কিন্তু প্রতি পদে মেয়েদের অসাম্য নিয়ে কতটা সরব হয়েছি? কেন মেয়েদের বেতন বহু ক্ষেত্রে কম? কেন কর্মক্ষেত্রে বহু সময়েই তাঁরা সমমর্যাদা পান না? কেন পরিবারেও অসাম্য চলে?” বলে চলেন, “পাশাপাশি একটা কথাও সকলকে ভেবে দেখতে বলব। আমরা এক জন মহিলা ডাক্তারের খুন-ধর্ষণ নিয়ে বিচলিত। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব কৃষক পরিবারের একটি মেয়ের এমন মৃত্যুও আমার কাছে সমান উদ্বেগের। শিকড় থেকে পরিবর্তনটা দরকার।” উত্তেজিত শোনায় তাঁর গলা।
কয়েক মুহূর্ত পরে নিজেই হেসে ফেলেন। বলেন, “আমার নামটাই আমার হাতে একটা অদৃশ্য ত্রিশূল তুলে দিয়েছে। কলকাতায় পৌঁছতে পারি বা না-পারি, মনে মনে এই শহরের মানুষের সঙ্গেই থাকি, আছিও। এ বারের দুর্গা মায়ের পুজো আমার কাছে অন্য রকম তাৎপর্যের। যেখানেই থাকি পুজোর ক’দিন, বলব, মাগো, ক্ষমতার আস্ফালন যুগে যুগে বড় কদর্য চেহারা নিয়েছে। তার বিনাশ করো। চারপাশটা বাসযোগ্য করে তোলো।”