দুর্গা বেশে মেয়েটি মহিষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অসুরের বুকে ত্রিশূল বিঁধিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের চার পাশে ঘুরে বেরানো গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতীরা বাহন নিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকের গায়ে উজ্জ্বল রঙের পোশাক আর মুখে ছৌ-মুখোশ। এমনই দৃশ্য মঞ্চে প্রায়ই তুলে ধরেন মাধবডিহির কাইতি গ্রামের পারমিতা, শিলারা। পর্দার পিছনে থাকা তাঁদের নিজ জীবনে লড়াইও কিন্তু কিছু কম নয়।
মহিলাদের ছৌ নাচের দলে দুর্গা সাজেন পারমিতা দাস, আর মহিষাসুর শীলা মণ্ডল। আবার পুরুষ ও মহিলারা যখন এক সঙ্গে ছৌ নাচ পরিবেশন করেন, দুর্গা হয়ে যান শীলা। বেশ কয়েক বছর ধরে ছৌ নাচের দল পরিচালনা করছেন বিশ্বরূপ বেজ। তাঁর কথায় “পাড়াগাঁয়ের মেয়েরাই এগিয়ে এসেছিলেন ছৌ নাচ শেখার জন্য। তাঁদের নিয়ে মেমারি, কাটোয়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করি।”
পারমিতা রায়নার শ্যামসুন্দর কলেজের কলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা রঞ্জিত টোটোচালক, মা পাপিয়া সংসার সামলান। ভাই শুভজিৎ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ৯-১০ বছর ধরে পারমিতা ছৌ নাচের সঙ্গে যুক্ত। এ থেকে যে ক’টা টাকা আয় করেন, সেই টাকায় নিজের বই কেনা, গৃহশিক্ষকের মাইনে, কলেজের টাকা দেওয়া— সবই চালান। ভাইয়ের পড়ার খরচও তিনি দেন। তাঁর কথায়, “ছৌ নাচের জন্য অনেক কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নাচ করেছি। তবেই না পড়াশোনা হয়েছে। না হলে তো কবেই বিয়ে দিয়ে দিত!”
কাইতির পাশের গ্রামে বাড়ি শীলার। ৩০ বছরের শীলা শুরু থেকেই ছৌ নাচের দলে রয়েছেন। তাঁর স্বামী শিশির মণ্ডলও টোটোচালক। তাঁদের একটি মেয়ে আছে। শীলা জানান, এই শিল্পে যুক্ত থেকে যে ক’টা টাকা মেলে, তা মেয়ের পড়ার কাজে লেগে যায়। সংসারের কাজেও লাগে। তিনি বলেন, “মেয়েকে বলি, পড়াশোনা করে শিক্ষিত হলে প্রতিবাদ করার একটা বাড়তি ক্ষমতা যোগ হয়।” শীলা নিজেও শ্যামসুন্দর কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন।
বিশ্বরূপ বেজ জানান, যাঁরা এগিয়ে আসছেন, তাঁরা বেশির ভাগই দিন আনি দিন খাই পরিবারের মেয়ে। যখন তাঁরা দুর্গা সাজেন, ভুলে যান ঘরে মাটির দেওয়াল আর টিনের চালের কথা। দেবী হয়ে ওঠেন অন্তরে। তিনি বলেন, “অনুষ্ঠান করে ফেরার সময় বদমাশ ছেলেদের পাল্লায় পড়েছি। আমাদের দুর্গারাই রুখে দাঁড়িয়েছে।”
পারমিতা আর শিলা আর জি কর ঘটনা জানেন। বলেন, “যাঁর প্রাণ বাঁচানোর ক্ষমতা রয়েছে, তাঁকেই কি না অসুরের হাতে নিধন হতে হল!” সর্বত্র মেয়েদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা খুব জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন।