• ডেঙ্গি-চিকিৎসায় সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে ফলস্ নেগেটিভ রিপোর্ট
    আনন্দবাজার | ০৯ অক্টোবর ২০২২
  • বছর চল্লিশের যুবকের তীব্র জ্বর। কিছুতেই কমছে না। ডেঙ্গি পরীক্ষায় দেখা গেল, রিপোর্ট নেগেটিভ। কিন্তু কয়েক দিন পরে আচমকাই তাঁর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ল। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষায় জানা গেল, ওই যুবক ডেঙ্গিতে আক্রান্ত। প্লেটলেটও নেমে গিয়েছে ২০ হাজারের নীচে। প্রশ্ন হল, প্রথম পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়ল না কেন?

    গত অগস্টে কলকাতা পুরসভা এলাকার বাসিন্দা, ১২ বছরের এক কিশোরের ডেঙ্গিতে মৃত্যুর পরে এমন ‘ফলস্ নেগেটিভ’-এর বিষয়টি উঠে এসেছিল। প্রথমে রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও, অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করলে দেখা যায়, সে ডেঙ্গি হেমারেজ়িক শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। প্লেটলেট দ্রুত কমছে।

    কিছু দিন ধরে রাজ্য তথা শহরে ডেঙ্গি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এ হেন ‘ফলস্ ডেঙ্গি’র ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কী পরীক্ষা, কখন, কী ভাবে করা হচ্ছে, সেটাই আসল বিষয়। সেখানে কোনও ফাঁক থাকলেই বিপত্তি। তাতেই ‘ফলস্ নেগেটিভ’ এসে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে।

    কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের কথায়, “ডেঙ্গি ধরতে হলে ঠিকঠাক পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। না হলে ভুল রিপোর্টের আশঙ্কা থেকে যায়। যা রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর। কোন সময়ে কী পরীক্ষা করাতে হবে, তা নিয়ে মানুষেরও ধারণা খুব কম।” চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, জ্বর চার দিনের কম থাকলে এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাতে হয়। কিন্তু তার বেশি সময় হয়ে গেলেআইজিএম পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। না হলে ঠিকঠাক রিপোর্ট মিলবে না। আবার যাঁদের আগে ডেঙ্গি হয়েছে, পরে আবার হচ্ছে (সেকেন্ডারি), তাঁদের ক্ষেত্রে এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ না-ও আসতে পারে। পাশাপাশি, ডেঙ্গির চারটি সেরোটাইপ (১, ২, ৩, ৪) আছে। ২ এবং ৪ নম্বর সেরোটাইপ সংক্রমণের ক্ষেত্রে এনএস-১ র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন কিট খুব ভাল কাজে দেয় না। সেখানে ফলস্ নেগেটিভের আশঙ্কা থাকে। আর ডেঙ্গির ক্ষেত্রে এমনিতেই এনএস-১ অ্যান্টিজেন মোটেই যথাযথ পরীক্ষা নয়।

    চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, জ্বরের তথ্যও সব সময়ে রোগীরা ঠিক মতো দেন না। অরুণাংশু জানান, জ্বর না কমায় রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসছেন, তখন হয়তো তিন-চার দিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই সময়টারোগী হয়তো ঠিক মতো উল্লেখ করতে পারলেন না। কিংবা বললেন। তখন ডেঙ্গি পরীক্ষা করার কথা লেখা হল। এ দিকে পরদিন রোগী যখন পরীক্ষা করাতে গেলেন, তখন সেটা চতুর্থ বা পঞ্চম দিন। তাতে এনএস-১অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করালে নেগেটিভই মিলবে। তাঁর কথায়, “তাই অনেক চিকিৎসকই যখন দেখেন, জ্বর না কমার মেয়াদ তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে রয়েছে, তখন এনএস-১ অ্যান্টিজেন এবং আইজিএম, দু’টি পরীক্ষা করানোর কথাই আলাদা করে উল্লেখ করে দেন। তাতেই নির্ভুল ফলাফল জানা সম্ভব।”

    আবার এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মধ্যেও সমস্যা থেকে যায় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই জানাচ্ছেন, এনএস-১ র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন কিটের পরীক্ষা থেকে সব সময়েঠিকঠাক রিপোর্ট আসে না। তাই কিটের দ্বারা নয়, ওই পরীক্ষা অ্যালাইজ়া পদ্ধতিতে হওয়া প্রয়োজন। তিনি এ-ও বলছেন, “ডেঙ্গি না হয়ে অন্যান্য ভাইরাল হেমারেজিক জ্বরেও রক্তে প্লেটলেটের মাত্রা কমতে পারে।সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। তবে ডেঙ্গির যাবতীয় পরীক্ষা অ্যালাইজ়া পদ্ধতিতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।” প্রথম ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টা প্লেটলেট নির্দিষ্ট পরিমাণেই থাকে বলে জানাচ্ছেন ক্রিটিক্যাল কেয়ারের চিকিৎসক সৌতিক পাণ্ডা। তাঁর কথায়, “ওই সময়ের পর থেকে শরীরের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তাতে প্লেটলেট ধ্বংস হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার জন্য শরীরেও কিছুটা সময় লাগে। তবে যখন ধ্বংস হওয়া শুরু হয়, তখন প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার করে প্লেটলেট নামতে শুরু করে।”

    সমস্ত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষারই কিছু দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন ভাইরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তাঁর কথায়, “সেই দুর্বলতা থেকেই ফলস্ পজ়িটিভ বা নেগেটিভ রেজ়াল্ট বেরিয়ে আসে। ডেঙ্গি পরীক্ষাও তার ব্যতিক্রম নয়। এ ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে নমুনা না নিলে ফলাফল নেগেটিভ হতেই পারে। সেখানে ভাইরাসের পরীক্ষাকে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

  • Link to this news (আনন্দবাজার)