তমালিকা বসু, লন্ডন: তিন বছর পর আবার লক্ষ মানুষের সমাগম হল শনিবার বর্ষশেষের রাতে টেমসের ধারে।
২০২২ সালকে বিদায় জানাতে লন্ডনের আকাশে ১৫ মিনিট ধরে চলল ২০০ ফুট উঁচু আলোর বাজি। সারাইয়ের কাজের জন্য বন্ধ থাকা বিগ বেন এই প্রথম নতুন বছরের আহ্বান জানাতে ঠিক রাত ১২ ঢং ঢং করে বেজে উঠল। একই সঙ্গে তীব্র আলোর ছটায় আলোকিত হয় হর্সেস গার্ড ভবন ও ডাউনিং স্ট্রিট অঞ্চল। আলোর খেলা সেখানে শ্রদ্ধা জানায় প্রথমেই নীল হলুদ রঙের মাধ্যমে ইউক্রেনের প্রতি। রামধনু রং এর আলোর কারসাজি শ্রদ্ধা জানায় রূপান্তরকামীদের। আকাশে তখন পৌঁছে গিয়েছে লক্ষ ড্রোন। ড্রোন আলোর কারুকাজ মেঘ ভর্তি লালচে আকাশের বুকে ফুটিয়ে তোলে প্রয়াত দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথের প্রতিকৃতি। 'হার ম্যাজেস্টি' দ্য কুইনের উদ্দেশে চলে গান।
ড্রোনের আলো আকার বদলে সঙ্গে সঙ্গে রাজা তৃতীয় চার্লসের আকার নেয়। শনিবার রাতে লন্ডন আইয়ের বুক থেকে উৎসারিত আলোর ক্ষেপণাস্ত্র এভাবেই অতীত ও আগামীর সন্ধিক্ষণের সাক্ষী রইল। নদীর উল্টোধারে তখন হুল্লোড়বাজ জনতার মুখরিত কলরব।
প্রতি বছরের ন্যায় টেমসের সাউথব্যাংকের ধারে বর্ষবরণের জন্য তুমুল আলোর বাজির আয়োজন করেন মেয়র অফ লন্ডন সাদিক খান। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির জন্য ২০১৯ এর পর এই বাজির উদযাপনে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এ বছর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে এবং নিউ ইয়ার্স ইভের ফায়ারওয়ার্কস বা বাজির মালা দেখতে লক্ষ টিকিট দু'সপ্তাহ আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। উৎসাহীদের দল শনিবার সন্ধ্যে ৮ টা থেকেই টেমসের ধারে ভিড় জমান। যার জন্য নামে হয়েছে মেট পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স। ভিড় সামলানোর জন্য ছিল একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
মাঝরাতের আলোকচ্ছটা ম্লান করতে সকাল থেকেই লন্ডনের আকাশের মুখ ভার ছিল। আজ সারাদিন বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি চলে রাত ১১ টা পর্যন্ত। শনিবার সারাদিন ১২ মিমি বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও টিকিটধারী জনতা খারাপ আবহাওয়ার ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে টেমসের দিকে পা বাড়ায়।
রাত ১২ টার কাছাকাছি বৃষ্টি কমে যায় তবে ঝোড়ো হাওয়া ছিল টেমসের ধারে।
বর্ষশেষের উৎসবমুখী জনতার উৎসাহে জল ঢালতে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, এই সপ্তাহান্তে বেশ কিছু লাইনে কাজ চলবে তাই লন্ডন ও শহরতলির দিকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। বেশ কিছু লাইনের টিউব বা পাতাল রেল কম সংখ্যায় চলেছে। বাজি উৎসব দেখে ঘর ফিরতি জনতার জন্য আরো নিরাশার খবর হল রাতের টিউব বা ট্রেনে কোনো বিনামূল্যে সফর এ বছর ছিল না।
কোভিড পূর্ববর্তী যুগে বর্ষশেষের রাতে ও বর্ষবরণের ভোর পর্যন্ত বিনামূল্যে সরকারি রেলে সফর করা যেত। এ বছর তার বিলুপ্তি ঘটেছে।
আজ থেকে ২০ বছর আগে প্রত্যেক বছর বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের উদযাপনে বাজির মাধ্যমে আকাশ রাঙিয়ে আলোর মালা সাজানো শুরু করে লন্ডন। ২০০৩ সালে তদানীন্তন মেয়র বরিস জনসনের হাত ধরে এই অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি হয়। এ বছর টিকিটের দাম ১৫ পাউন্ড থেকে শুরু। গড়ে ২০ লক্ষ পাউন্ড গত দু'দশক ধরে এই অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। বলা হয় অর্ধেক পয়সা টিকিট বিক্রিতে উঠে যায়। ২০২০ বর্ষশেষে ৩০ লক্ষ ড্রোন আলোর মাধ্যমে আকাশের বুকে কোভিড পরিস্থিতি অকল্পনীয় ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাজির দায়িত্বে থাকা জ্যাক মর্টন সংস্থা। কোভিড যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন থেকে শুরু করে জুম ও টিম কলের রমরমা সবই দেখিয়েছিল ড্রোন বাজি।
২০২২ শুরু হয়েছে ইউরোপের রক্তক্ষয়ী ইউক্রেন যুদ্ধ দিয়ে। ব্রিটিশ জনগণের কাছে শোকের মুহূর্ত ছিল প্রিয় রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণ। ২০২৩ এ জনতা মুখিয়ে রয়েছে রাজা তৃতীয় চার্লসের আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেকের জন্য। মেয়র অফ লন্ডনের অফিসের অন্দরের খবর ছিলই, বর্ষশেষের রাতের আলোর রোশনাই গগনচুম্বী ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সঙ্গে রাজপরিবারের সেই সদস্যের স্মৃতি টাটকা করবে।