• দূষণ গ্রাসে বাংলা! ভয়াবহ শঙ্কার কথা শোনালেন বিজ্ঞানী স্বাতী চক্রবর্তী
    ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
  • করাল গ্রাস থেকে বাদ নেই কলকাতা-সহ আপামর বাংলাও। বায়ুদূষণ থেকে শব্দ দূষণ, জল দূষণ থেকে আলোক দূষণ, ভিন্ন ভিন্ন দূষণে জেরবার মানুষের জীবন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী পরিবেশ দূষণের সার্বিক দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। দূষণের জেরে পরিবেশ উদ্বাস্তুর সৃষ্টি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

    প্রশ্ন- কলকাতার দূষণের সার্বিক কি পরিস্থিতি?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    কলকাতার দূষণের চিত্র ঠিক পুজোর সময় একটা পরিবর্তন হতে শুরু করে। পুজো, দিওয়ালি, শীতের শুরু, ভৌগলিক কারণ তো আছেই। দূষণের কারণ দেখা যায়, পুরনো কলকাতা, রাস্তা ঘাট, তার কনস্ট্রাকশন, কলকাতায় প্রচুর গাড়ি। এখনে কার্বন নিঃসরনের মাত্রায় ভারতের স্থান তৃতীয়। বছরে ৭.৩ টন কার্বন নিঃসরন হয়। সেখানে আমেরিকা ১৪.৩, চিন ৭.৬। কার্বন নিঃসরনের মাত্রা নিয়ে ভাবতে হবে। কলকাতার নতুন পার্ট নিউটাউন সেখানে কনস্ট্রাকশনজনিত দূষণ থাকছে। শব্দ দূষণ, আলোর দূষণ রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দূষণ দেখতে পাই। জল দূষণ রয়েছে। দূষণের মাত্রা বিভিন্ন। তার তীব্রতাও অনেক বেশি।

    প্রশ্ন- দূষণ থেকে কলকাতার কোনও মুক্তি নেই?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না। পরের প্রজন্মকে অক্সিজেন বহন করতে না হয়। বায়ুদূষণ বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে বেশি প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি হচ্ছে। কলকাতা ছাড়া হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়ায় একরকম চরিত্র, মধ্য কলকাতায় আরেক রকম চরিত্র।

    প্রশ্ন- আলোক দূষণ নিয়ে কি বলবেন?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    রাতের আকাশের কথা এখন ছোটরা ভুলে গিয়েছে। অকারণে প্রচন্ড ভাবে আলোর ব্যবহার বেড়েছে। কলকাতায় রাতের আকাশে তারা দেখার সুযোগ নেই। সেখানে শুধু আলোতেই ভরে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্ররাজি, তাদের যে পরিধিতি, পরিমাপ কোন আকাশে দেখা যায় এখন ছেলেমেয়েরা তা চিন্তাই করতে পারছে না, দেখতেও পাচ্ছে না। আলোর দূষণে আকাশ মুড়ে ফেলেছি। গাছের আলোর ব্যবহার করে কীটপতঙ্গের ভারসাম্য নষ্ট করছি। কোন জায়গায় কোন আলো ব্যবহার করব, কতটা করব। তার কোনও নীতি বা নিয়ন্ত্রণ নেই।

    প্রশ্ন- আমরা প্রাকৃতিক উদ্বাস্তু তৈরি করছি?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    এই বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। এক একটা কমপ্লেক্সে প্রচুর ফ্ল্যাট আছে। সেখানে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলকে সীমাবদ্ধ রেখে গ্রিনারিজ করতে হবে। ভার্টিক্যাল গার্ডেনিংয়ের বিষয়টা ভাবতে পারি। ভৌগলিক কারণ, ভূ-উষ্ণায়ন, কালবৈশাখী, ঝড়ঝঞ্ঝার প্রভাব আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গাছ উপরে পরার সম্ভাবনা আছে। তাই মাটির চরিত্র বা পরিবেশ না বুঝে অবৈজ্ঞানিকভাবে গাছ বসাচ্ছি। মাটি আলগা হলে গাছ প্রতিস্থাপন করতে হবে। ছোটগাছ বসালে হবে না। গাছ কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দিকে না তাকিয়ে মুনাফার দিকে তাকালে সমস্যা আছে।

    প্রশ্ন- পরিবেশ সচেতনতা বা জলাশয় বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিভাবে আটকানো যেতে পারে?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    কলকাতা পুরনো শহর। খাল পরিবেষ্টিত। বাগজোলা খাল, এখানে ইস্ট কলকাতা ওয়েট ল্যান্ড। ধাপার অঞ্চল। প্রতিনিয়ত এই ধরনের সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। ধাপা কলকাতার কিডনি। এখানে বায়ো ডায়ভার্সিটির মাধ্য়মে ন্যাচারলি পিউরিফাই হচ্ছে। নতুন প্রজেক্ট আনতে হবে কিভাবে জলাশয়গুলি মেন্টেইন করতে হবে।

    প্রশ্ন- বাড়ির পাশে দেখতে না পেয়ে এখন প্রজাপতি পার্কে যেতে হয়?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    কয়েক কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এই প্রজন্ম আজ প্রজাপতি দেখতে পাচ্ছি না। প্রজাপতি পার্কে যেতে হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে প্রজনন ঘটাতে হচ্ছে। সুতরাং এই দিকটা জেনেবুঝে এগোচ্ছি। রিসাইকেলিংয়ের দিকে এগোলে সচেতন ভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। আজ তাঁরা মৌমাছি চেনে না। সুন্দরবনে গেলেও মিলছে না। বহু মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। জলের পরিবর্তন হচ্ছে।

    প্রশ্ন- এয়ারহর্ন, মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণ থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি মিলবে?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    শব্দদূষণ ভীষণভাবে প্রভাব ফেলছে। এক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষরা সব থেকে বেশি এফেক্টেড। কারণ, শুধু বাস নয় বাড়ির পাশ দিয়ে যে বাইক যায়। এতো জোরে বাইকের হর্নের আওয়াজ হয় যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়। এই ধরনের বাইক টেকনোলজিক্যালি কিভাবে কলকাতার রাস্তায় অনুমতি দেওয়া হয় আমি জানি না।

    রাস্তায় এমন কিছু হর্নের চরিত্র দেখতে পাই তা কিন্তু আমাদের নির্দিষ্ট ডেসিবেলকে ক্রশ করে যাচ্ছে। কি করে বাস, ট্রাকগুলি করে ব্যবহার করছে, সরকার যদি আইন প্রয়োগ না করে তাহলে এমনি বন্ধ হবে বলে আমার মনে হয় না। আইনকে আরও বেশি কড়া হতে হবে। শব্দদূষণ যে একটা দূষণ তা ভুলে যাই। শীতকালে যার বাড়ির পাশে পিকনিক হচ্ছে বা যে অঞ্চলে হচ্ছে তাঁদের অসুবিধার কথা ভাবছি না।

    প্রশ্ন- মানুষ ভিটে ছাড়াও হচ্ছে।

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    হঠাৎ গরম বেড়ে যাচ্ছে। মরুভূমিতে বন্যা হচ্ছে। প্রকৃতিকে আহরন করার চেষ্টা করছে। কটা গাছ কাটলাম সেখানে কটা গাছ লাগানোর চেষ্টা করছি? প্রচুর সময় নষ্ট করছি। বিভিন্ন জায়গায় এফেক্ট হচ্ছে। দাবানল হচ্ছে। প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রাকৃতিক উদ্বাস্তু তৈরি করছি। পরিবশেগত কারণে উদ্বাস্তু। এটা অন্য দেশের কথা বলছি না এটা ভারতের কথা বলছি, পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি। মেদিনীপুরে বন্যা হচ্ছে। পরিবেশগত কারণে মানুষকে সরে আসতে হয়, ভিটে ছাড়তে হচ্ছে। এরাও কিন্তু পরিবেশগত কারণে উদ্বাস্তু। প্রভাব দেখছি কিন্তু উৎস খুঁজে সমাধানের চেষ্টা করছি না।

    প্রশ্ন- সমুদ্র, নদী পাড় ভাঙছে। উজার হচ্ছে জনবসতি?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    পেস্টিসাইড ব্যবহার করছি। মাটির চরিত্র বদল হচ্ছে। বৃষ্টি হলে সেগুলি নদীতে এসে মিশছে। নদী চরিত্র বদল করছে। ভূউষ্ণায়নের ফলে গ্লেসিয়াস, নদীয়ার জলধারার চরিত্র বদল ঘটছে। পলি মাটি এফেক্টেড হচ্ছে। নদীর চরিত্র বদল আমাদের ভাবাচ্ছে। বাধের চরিত্র বদল হওয়াটাও চিন্তার বিষয়। কিভাবে শক্তপোক্তভাবে মেইনটেন করা। কৃষিতে পরিবর্তন দিচ্ছে। বহু জেলা আছে যেখানে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করতে পারিনি। মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় জলে আর্সেনিকের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টকে কমপালসারি করা। প্রত্যেকটা বাড়িকে টেকনোলজিক্যালি উন্নত করতে হবে। আমাদের ভূগর্ভস্ত জল হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জিং করতে হবে। আমরা মাটির ওপর কংক্রিট দিয়ে গেঁথে দিচ্ছি। মাটিতে জল ধরার ক্ষমতা থাকছে না।

    প্রশ্ন- লকডাউনে কিছুটা পরিবেশ ফিরেছিল। সাধারণ সময়ে তা ফিরে পেতে পারে?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    মানুষই কিন্তু সমস্ত দূষণ তৈরি করছে। গাড়ি থেকে যে ধোঁয়া বেরচ্ছে তা থেকেই চারিদিকে কার্বনের মাত্রা বাড়ছে। তা বলে সমস্ত কিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে তা নয়। তবে যে জায়গায় আসতে হবে আমরা কতটা রিসোর্সটাকে ব্যবহার করব। আজ আমরা একটা ফোনের জায়গায় চারটে ফোন ব্যবহার করছি। ইলেকট্রনিক্স ওয়েস্ট যে তৈরি হচ্ছে আমরা এটাকে ভাবনার মধ্যেই আনছি না। প্রত্যেক বছর ৯.৮ শতাংশ হারে এই ওয়েস্ট বাড়ছে। এটা শুধু ভারতের চিত্র। আমাদের বাড়িত একটার বেশি টিভি, প্রতি রুমে এসি। কতটা ব্যবহার করব তা ভাবা দরকার। রিসাইকেলিং করার কথা ভাবতে হবে। লকডাউনে নির্মল আকাশ দেখতে পেয়েছি তার জন্য রিসাইকেলিং, রিইউজ খুব দরকার।

    প্রশ্ন- কি ধরনের পরিমাপ রয়েছে দূষণের ক্ষেত্রগুলিতে?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    বাতাস কতটা দূষিত তা ইকুয়া ইনডেক্স দিয়ে দেখি। পার্টিকুলার মাত্রা দেখি। ১৫০-এর বেশি হলে সাঙ্ঘাতিক ভাবে দূষিত হচ্ছে ধরতে পারি। যেটা কলকাতার মতো জায়গায় সবসময় ২০০-২৫০ থাকছে। একমসয় রাস্তা ধোয়া হত। এখন ধূলোটা থেকে যাচ্ছে। মাটি থেকে ৫ ফুট উচ্চতার মধ্যে এই পার্টিকুলারগুলি ঘুরতে থাকে। সেই জন্যই এই সিওপিডি, স্কিনস, চোখের সমস্যা আটকালে পার্টিকুলার ম্যাটারগুলো কমানো বিশেষ প্রয়োজন। সাউন্ড সিস্টেম ৬০ ডেসিবেলের ওপর সব হর্ণগুলি পেরিয়ে যাচ্ছে। এই মাত্রা বজায় রাখতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ স্থানীয়-স্তরে এই হর্ণের ব্যবহার কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

    প্রশ্ন- ব্রাজিল গিয়ে কি দেখলেন?

    ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী-

    ব্রাজিল পুরোপুরি কৃষি নির্ভর। ইথানলের উৎপাদনের ওপর ব্রাজিল নির্ভরশীল। বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এখানে ইথালনের উৎপাদন নেই। আমরা সেই ধরনের আখ চাষ করতেই পারছি না। আখ শিল্প বন্ধের মুখে সেটা পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করেছিলাম পাটচাষের মাধ্যমে। কম জলে চাষ করার প্রযুক্তি উন্নয়ন তারা প্রয়োগ করতে পারছে। আমাদের জলবায়ুগত কারণে নয়া প্রযুক্ত আরও বেশি প্রয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন অনেক বেশি করতে পারছে ব্রাজিল।
  • Link to this news (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)