• পাকিস্তানের সামরিক শাসক থেকে হত্যা মামলায় পলাতক, কেমন ছিলেন পারভেজ মুশারফ?
    ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
  • পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ৭৯ বছর বয়সে দীর্ঘ অসুস্থতার পরে রবিবার দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দূতাবাসের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে একথা জানিয়েছে। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল মুশারফ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর প্রায় এক দশক তিনি পাকিস্তান শাসন করেছেন। ১৯৯৯ সালে লাহোর চুক্তিকে বানচাল করতে মুশারফ কার্গিলে সেনা অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন। সেই নিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার চাপের মুখে মুশারফকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তার জেরেই শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মুশারফ।

    জেনারেল মুশারফ ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনার জয়েন্ট স্টাফ কমিটির ১০ম প্রধান ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনার সপ্তম সেনাপ্রধানের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৯৪৩ সালে নয়াদিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন জেনারেল মুশারফ। তাঁর যখন চার বছর বয়স, সেই সময় তাঁকে নিয়ে তাঁর মা-বাবা পাকিস্তানে চলে যান। ১৮ বছর বয়সে জেনারেল মুশারফ পাকিস্তান সেনায় যোগ দেন। পাকিস্তান সেনার কমান্ডো ইউনিটের দায়িত্বেও ছিলেন। তিনি পাকিস্তানে উদার অর্থনীতির পক্ষে ছিলেন। পাশাপাশি, পাকিস্তানে উদার মূল্যবোধের সূচনা করার চেষ্টা করেন।

    সরকারে থাকাকালীন তাঁর প্রাথমিক বছরগুলোয় জেনারেল মোশারফ তাঁর সংস্কারবাদী চেষ্টার জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। মহিলাদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। প্রথমবারের মতো বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলগুলোকে সংবাদ পরিচালনার অনুমতি দিয়েছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর তিনি ওয়াশিংটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে পাকিস্তানি সেনার পিছনে অর্থব্যয়ে উৎসাহিত করেন।

    এর মধ্যেই, জঙ্গিরা ২০০৩ সালে মুশারফের কনভয় লক্ষ্য করে দু’বার হত্যার চেষ্টা করেছিল। প্রথমে একটি সেতুর ওপর বোমা রাখা ছিল। দ্বিতীয়বার গাড়ি বোমার সাহায্যে তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়। দ্বিতীয় আক্রমণে মোশারফের কনভয়ের গাড়িটি আবার বিস্ফোরণে মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে উড়ে গিয়েছিল। রক্ষীরা মুশারফের গাড়ি আটকে দাঁড়িয়েছিল। মুশারফ নিজে হাতে একটি গ্লক পিস্তল তুলে নিয়েছিলেন লড়াইয়ের জন্য।

    যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরবর্তী বছরগুলোয় তিনি বেশ কর্তৃত্বের সঙ্গে শাসন করেছেন। ২০০২ সালের শেষের দিকে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন করেছিলেন। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদকে বরখাস্ত করার জন্য এবং নিজেকে ব্যাপক ক্ষমতাশালী করার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করেছিলেন। এরপর তিনি ২০০৪ সালের শেষ নাগাদ সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন করেননি। ২০০৬ সালে মুশারফের নির্দেশে পাকিস্তান সেনা বেলুচিস্তানে এক উপজাতি প্রধানকে হত্যা করে। যার জেরে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের ভিত্তি তৈরি হয়। সেই বিদ্রোহ আজও চলছে।

    ২০০৭ সালে, একটি আত্মঘাতী হামলায় খুন হন বিরোধী নেত্রী বেনজির ভুট্টো। এতে পাকিস্তানজুড়ে হিংসা শুরু হয়। বেনজির ভুট্টো হত্যা মামলা এবং লাল মসজিদের ইমাম হত্যা মামলায় মুশারফকে পলাতক ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করার জন্য মুশারফের চেষ্টাতেও পাকিস্তানের বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়।

    দীর্ঘ ১১ বছর পর ২০০৮ সালে পাকিস্তানে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে হেরে যায় পারভেজ মুশারফের দল।পার্লামেন্টে চাপের মুখে মুশারফ প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। লন্ডনে পালিয়ে যান। ফের পার্লামেন্টে একটি আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ২০১৩ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। কিন্তু, তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এরপর তাঁকে ২০১৬ সালে দুবাই যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

    ২০১৯ সালে, পাকিস্তানের এক আদালত সেদেশে অনুপস্থিত মুশারফকে ২০০৭ সালে জরুরি শাসন জারির জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে অবশ্য রায়টি বাতিল করা হয়। মুশারফের পরিবার ২০২২ সালের জুনে ঘোষণা করেছিল যে প্রাক্তন একনায়ক অ্যামাইলয়েডোসিসে আক্রান্ত। সেই সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এটি একটি দুরারোগ্য রোগ। যাতে শরীরের অঙ্গগুলোয় প্রোটিন তৈরি হয়। সেই সময় মুশারফের পরিবার জানিয়েছিল, ‘আমরা একটি কঠিন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এমন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে, যেখান থেকে অবস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।’
  • Link to this news (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)