• 'সাধারণ মেয়ে' শ্বেতার উত্থানে অবাক পড়শিরা
    এই সময় | ২২ মার্চ ২০২৩
  • এই সময়, কামারহাটি ও চুঁচুড়া: ছিপছিপে চেহারার সুন্দরী মেয়েটি চাকরি করতেন কামারহাটি পুরসভায়। সঙ্গে ছিল মডেলিংয়ের নেশা। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের শান্ত স্বভাবের সেই মেয়ের নাম কোটি কোটি টাকার নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় অবাক নৈহাটির ৭/ডি বিজয়নগর জেলেপাড়ার বাসিন্দারা। নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার চুঁচুড়ার অয়ন শীলের বান্ধবী সেই শ্বেতা চক্রবর্তীর রহস্য সন্ধানে এখন তৎপর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের আধিকারিকরা।

    নৈহাটির সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে শ্বেতা। বাবা অরুণ চক্রবর্তী রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী। দোতলা বাড়িতে বাড়িতে মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন ওই তরুণী। নৈহাটি কাত্যায়নী গার্লস হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কলকাতার একটি বেসরকারি কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন শ্বেতা। জিরাট গ্রাম পঞ্চায়েতে স্কিল টেকনিক্যাল পার্সন পদে সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে ছিলেন শ্বেতা।

    ২০১৪ সালে জিরাট গ্রাম পঞ্চায়েতে ফিল্ডে গিয়েও কাজের তদারকি করতেন তিনি। একটা সময় শ্বেতার বাবা মা মেয়েকে নৈহাটি থেকে জিরাটের কর্মস্থলে দিয়ে যেতেন ও কাজ শেষে বাড়ি নিয়ে যেতেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্বেতাকে নিয়ে জিরাট পঞ্চায়েতে নানা কানাঘুষো ছিল। পঞ্চায়েতের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা বিডিওর কাছে অভিযোগ করতেই শ্বেতাকে শোকজ করেন বিডিও।

    ২০১৪ সালেই অয়নের সঙ্গে যোগাযোগ হয় শ্বেতার। অয়ন ওই সময় ডুমুরদহ নিত্যানন্দপুর ১ পঞ্চায়েতে নির্বাহী আধিকারিক হওয়ার সুবাদে প্রভাব খাটিয়ে শ্বেতাকে নিজের অফিসে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেখানেও অয়ন ও শ্বেতার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দু'জনেই চাকরিতে ইস্তফা দেন। শ্বেতার নাম অয়নের সল্টলেকের অফিস থেকে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। অয়নের সঙ্গে যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং নানা সম্পত্তির নথিতেও শ্বেতার নাম মিলেছে। পাড়ার মেয়ে সম্পর্কে এ সব কথা শুনে শ্বেতার প্রতিবেশীরাও তাজ্জব।

    তাঁদের কথায়, 'প্রথম দিকে শ্বেতাকে একটি কালো গাড়ি বাড়ি থেকে নিয়ে যেত এবং রাতে পৌঁছে দিত। পরে অন্য একটা গাড়ি ওদের বাড়ির পাশের গ্যারাজে রাখা থাকত।' শ্বেতার বাবা অরুণ চক্রবর্তী বলেন, 'অয়নের স্ত্রী কাকলির সঙ্গে মেয়ের পরিচয় হয়। মেয়ে মডেলিং করার সুবাদে অয়ন শীলের কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কাজ করে‌। যে গাড়ি কেনার কথা বলা হয়েছে তাতে মেয়ের কিছু টাকা আছে। বাকি ৪-৫ লক্ষ টাকা হয়তো পারিশ্রমিক হিসেবেই অয়ন দিয়েছিল।' শ্বেতা এ দিন বাড়িতে থাকলেও সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। তাঁর ফোনও বন্ধ ছিল।

    পঞ্চায়েতের চাকরি ছাড়ার পর ২০১৯ সালে কামারহাটি পুরসভায় সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) পদে চাকরিতে যোগ দেন শ্বেতা। নিয়মিত অফিসও করতেন তিনি কিন্তু নিয়োগ তদন্তে অয়নের নাম উঠে আসার পর গত কয়েকদিন ধরে তিনি পুরসভায় আসছিলেন না। একাধিক সূত্রের দাবি, উত্তর ২৪ পরগনার প্রভাবশালী এক প্রবীণ বিধায়কের সঙ্গে অয়নের মধুর সম্পর্ক থাকার সুবাদেই কামারহাটি পুরসভায় চাকরি পান শ্বেতা।

    পুরপ্রধান গোপাল সাহার দাবি, 'সবটাই সরকারি নিয়ম মেনে হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমেই বেসরকারি একটি সংস্থাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বরাত দেওয়া হয়েছিল। পুরসভার তরফে কোনও অনিয়ম হয়নি।' এ দিকে, কামারহাটি পুরসভার উল্টোদিকে জগন্নাথ নিকেতন আবাসনে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অয়নের সঙ্গে শ্বেতা মাঝেমধ্যে থাকতেন বলে জানা গিয়েছে। ওই আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী শঙ্কর জানা বলেন, 'দু-একবার আসতে দেখেছি।

    আবার গাড়ি করে তারা বেরিয়ে যেতেন।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবাসিক বলেন, 'ওরা দু'জন থাকত এখানে। কয়েকদিন আগে মেয়েটিকে দেখা গিয়েছিল। তবে অয়ন শীলকে বছরখানেক হলো ফ্ল্যাটে আসতে দেখা যায় না।' পড়শিরা জানিয়েছেন, ৪-৫ দিন আগে পরিচারিকা এসে প্যাকেট ভর্তি ময়লা ফেলে দিয়ে যায়। চুঁচুড়া জগুদাসপাড়ায় আবাসনেও এক সময় থাকতেন শ্বেতা। এই সম্পর্ক নিয়ে অয়নের পরিবারে অশান্তি তৈরি হয়। আবাসনের বাসিন্দা বিশ্বনাথ মোদক বলেন, 'অয়নের ফ্ল্যাটে একটা মেয়েকে থাকতে দেখেছি। খুব আধুনিক সাজপোশাক পরত। একবার ওর বাবা-মাও এসেছিলেন।'

    জগুদাসপাড়ার রংচটা পুরোনো দোতলা বাড়িতেই থাকেন অয়নের বৃদ্ধ বাবা মা। বেসরকারি সংস্থা থেকে অবসরের পর এখনও গৃহশিক্ষকতা করেন অয়নের ৮৪ বছরের বাবা সদানন্দ শীল। ছেলের গ্রেপ্তারির পর থেকেই বাড়ির বাইরে বের হননি সদানন্দ ও তাঁর স্ত্রী অমিতা। এ দিন অবশ্য বৃদ্ধ সদানন্দ সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেন, 'এই বয়সে আমি এখনও ছাত্র পড়াই।

    ছেলের ঘটনায় মনে হচ্ছে সব কিছু ফর্মুলা মেনে হয় না।' অয়নের শ্বশুর চুঁচুড়া কারবালা মোড়ের বাসিন্দা মনোরঞ্জন দাসও বলেন, 'কম্পিউটারের খুঁটিনাটি খুব ভালো জানত বলেই হয়তো জামাইকে ব্যবহার করা হয়েছে।' ২২ বছর আগে মনোরঞ্জনের মেয়ে কাকলির সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে হয় অয়নের। ছেলের পড়াশোনার জন্য কাকলি ছেলের সঙ্গে দিল্লিতে থাকেন। অয়নের শ্বশুর এ দিন বলেন, 'বিয়ের পর হাতেগোনা কয়েকবার আমার বাড়িতে এসেছে জামাই। তবে আমার মেয়ে এত গভীর ভাবে বিষয়টা জানত না।
  • Link to this news (এই সময়)