• মোহনবাগানের সংবর্ধনা মঞ্চে মাইক কাড়তে গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে, টুটু আছেন টুটুতেই!
    আনন্দবাজার | ২২ মার্চ ২০২৩
  • এমনিতেই তাঁর মুখের আগল খুব একটা নেই। দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং মঞ্চ নির্বিশেষে তিনি অনর্গল। বহু বছর আগে একই মঞ্চে এক হাতে অমিতাভ বচ্চনের হাত খামচে ধরে অন্য হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কচি করে কিছু দিয়ে যাও গুরু!’’ অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ‘বাংলার জামাই’ খানিক অপ্রতিভ হয়েছিলেন। তবে ‘কচি করে’ কিছু দিতে চাননি। অকুস্থলে হাজির টুটুবাবুর কিছু হিতৈষী বিড়ম্বিত হয়েছিলেন। কিছু হিতৈষী জনান্তিকে বলেছিলেন, ‘‘আইন করে টুটু’দার কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া উচিত!’’ কিন্তু তিনি, মোহনবাগানের সভাপতি এবং রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ টুটু বসু আর কবে ও সবের তোয়াক্কা করলেন!

    যেমন করেননি গত সোমবার। আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে মোহনবাগান তাঁবুতে ফুটবলারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই মঞ্চেও যাবতীয় নজর কেড়ে নিয়েছেন টুটুই। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দেওয়ার সময় টুটু তাঁর হাত থেকে মাইক্রোফোনটিও কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। একেবারে শেষমুহূর্তে ‘গোললাইন সেভ’ করেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তবে গোটা ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীকে দৃশ্যতই খানিক বিরক্ত এবং ক্ষুণ্ণ দেখিয়েছিল।

    আগে থেকেই ঠিক ছিল, মোহনবাগান তাঁবুতে মুখ্যমন্ত্রী আসবেন বেলা ১২টায়। তখনই অনুষ্ঠান শুরু হবে। ক্লাব সূত্রের খবর, সবুজ-মেরুন সভাপতি টুটুর সংবর্ধনা মঞ্চে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি সকাল সকাল ক্লাবে পৌঁছে বেলা ১১টা থেকেই মঞ্চে উঠে বসে পড়েন। অসমর্থিত সূত্রের খবর, টুটুকে এক বার নিষেধও করা হয়েছিল অনুষ্ঠানে আসতে। কিন্তু তিনি সটান জানিয়ে দেন, তিনি ক্লাবের সভাপতি। তাঁকে বাধা দেবে কে! সূত্রের খবর, মন্ত্রী অরূপকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল টুটুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করানোর। কিন্তু তিনি সবিনয়ে জানান, তাঁর সেই এলেম নেই।

    মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের রেওয়াজ মেনে মঞ্চে সকলের জন্য নাম লেখা নির্দিষ্ট আসন ছিল। টুটু দ্রুত মঞ্চে উঠে একটি চেয়ারে বসে পড়েন। মোহনবাগানের ফুটবল সচিব স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে (বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ঘটনাচক্রে মুখ্যমন্ত্রী ভাই) প্রথমে দেখা যায় টুটুর পাশের চেয়ারে বসে কিছু একটা বোঝাচ্ছেন। তবে তাতে কাজ হয়নি। এর পর বাবুন এবং মোহনবাগান সচিব দেবাশিস দত্ত কিছু চেয়ার নতুন ভাবে এ দিক-ও দিক করতে থাকেন।

    বস্তুত, বক্তার তালিকাতেও টুটুর নাম ছিল না। কিন্তু তিনি কার্যত মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতা পেশ করেন। মাইক হাতে নিয়েই টুটু প্রশংসা করতে শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই বাবুনের। পরিবারের সদস্যের বেলাগাম প্রশংসা শুনে দৃশ্যতই মমতা খানিক বিরক্ত হন। কারণ, তিনি সে ভাবে কখনওই নিজের পরিবারকে সামনে আনেন না। বরং বলেন, সারা বাংলাই তাঁর পরিবার। বস্তুত, তাঁর পরিবারের কেউ তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে থাকুন, তা-ও খুব একটা পছন্দ করেন না মুখ্যমন্ত্রী। আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

    টুটু অবশ্য সে সব দিকে নজর না দিয়ে বলতে থাকেন, ‘‘আমি একটা সিক্রেট কথা বলব? দিদির একটা ভাই আছে। স্বপন। ওর নাম বাবুন। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে দিদি আমায় ডেকে বললেন, টুটু’দা, আমি চাই না আমার এই ভাইটা রাজনীতি করুক। একে আপনি মোহনবাগানে নিয়ে যান। এ মাঠের ছেলে।’’ টুটু যখন এই বক্তব্য পেশ করছেন, মুখ্যমন্ত্রী চোখেমুখে তখন স্পষ্টই বিরক্তি। কিন্তু টুটু বলতে থাকেন, ‘‘বিশ্বাস করবে বাবুন? সেই বাবুন এখন শুধু মোহনবাগান নয়, হকিটাকে দাঁড় করিয়েছে। ইন্ডিয়ার অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশনে জড়িত হয়েছে। এবং আমার প্রাণের কবাডিটাও দেখছে। দিদি বোধহয় এগুলো জানেন না।’’ টুটু যখন নাগাড়ে বাবুন সম্পর্কে বলে যাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী তখন একমনে কয়েকটি ফুটবলে সই করে যাচ্ছিলেন। এ বারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মাইক্রোফোনে টুটু বলতে থাকেন, ‘‘দিদি কি শুনতে পাচ্ছেন? দিদি, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আপনার বাবুন এখন কবাডি, হকি সবেতে জড়িত হয়েছে। যাকে আপনি দিয়েছিলেন।’’

    মুখ্যমন্ত্রী তার কোনও জবাব দেননি। তিনি টুটুকে খানিকটা অগ্রাহ্য করেই আসন থেকে উঠে পরিচিত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনে দর্শকদের মধ্যে বল ছোড়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। কিন্তু টুটু তখন ‘ফ্লো’ পেয়ে গিয়েছেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘‘ওরে বাবা, পায়ে মারবেন নাকি! দিদি, পায়ে মারুন। পায়ে মারুন একখানা।’’ মমতা অবশ্য তাতে কান দেননি। তিনি হাতে করেই পর পর তিনটি বল ছুড়ে দেন দর্শকদের উদ্দেশে। তখন তা দেখে বিমোহিত টুটু বলতে থাকেন, ‘‘ওরেব্বাবা! ওরে শাবাশ! ওরে বাবা রে!’’

    অবশ্য সেখানেই টুটু-কাহিনি থামেনি। মুখ্যমন্ত্রী যখন মাইক্রোফোন-হাতে ভাষণ দিচ্ছেন, তখন টুটু আবার হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে মমতার কাছে চলে যান। মুখ্যমন্ত্রী ‘নমস্কার’ শব্দটি বলামাত্রই টুটু মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে মাইকটি কেড়ে নিতে যান। সঙ্গে আবদার জোড়েন, ‘‘একটা গান হবে না? একটা গান, একটা গান।’’

    বিড়ম্বিত মমতা বলেন, ‘‘আরে না-না-না-না।’’ অবস্থা বুঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে আসেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ। তিনি প্রায় জড়িয়ে ধরে টুটুকে বিরত রাখেন। তখনকার মতো কিছুটা শান্তও করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলতে শুরু করেন। তাঁর বক্তৃতার সময় অবশ্য টুটু শান্তই ছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের শেষ দিকে আবার তিনি তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। বলে ওঠেন, ‘‘একটা গান হয়ে যাক।’’ মুখ্যমন্ত্রী দৃশ্যতই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘‘গলা বসে গিয়েছে। এখন গান হবে না।’’

    পাছে আবার ছিটকে বেরিয়ে ডি বক্সে পৌঁছে যান, তাই অরূপ সারাক্ষণই ‘কড়া ডিফেন্ডার’-এর ভূমিকায় আগলে রেখেছিলেন টুটুকে। ফলে তিনি আর মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিতে আসতে পারেননি। শেষ দিকে মমতাও টুটুর দিকে তাকিয়ে ‘জয় বাংলা, জয় মোহনবাগান’ স্লোগান দিতে থাকেন। সম্ভবত ফুটবলের প্রাচীন পন্থা ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’ মেনে। শেষে মোহনবাগান সভাপতিকে একটি স্কোয়ার পাসে ঠেলে দেন অরূপের দিকেই,— ‘‘আচ্ছা, টুটুদা কী বলছে দেখো।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)