বাংলা কবিতা

  • বিদ্রোহী
    - নজরুল ইসলাম
  • বল বীর বল উন্নত মম শির
    শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির
     
    বল বীর বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
    চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
    ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া
    খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
    উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর
     
    মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর
    বল বীর আমি চির উন্নত শির
    আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস
    মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস
    আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর
     
    আমি দুর্বার
    আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার
    আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল
    আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
    আমি মানি না কো কোন আইন
    আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন
    আমি ধুর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
    আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর
     
    বল বীর
    চির-উন্নত মম শির
    আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি
    আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি
    আমি উন্মন মন উদাসীর
    আমি বিধবার বুকে ক্রন্দণ শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর
    আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের
    আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
    আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
    চিত-চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর
    আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখণ
    আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তা’র কাঁকন চুড়ির কন্ কন্
    আমি চির-শিশু, চির-কিশোর
    আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর
    আমি উত্তর-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া
    আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেনু-বীণে গান গাওয়া
    আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
    আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি
    আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি এ কি উন্মাদ, আমি উন্মাদ
    আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ
     
    আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
    মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্-ঘুম্
    ঘুম্ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম্
    মম বাঁশরীর তানে পাশরি
    আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী
    আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া
    ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া
    আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
    আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা
    কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল-ধ্বংস-ধন্যা
    আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা
    আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি
    আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কলা-ফণী
    আমি ছিন্নমন্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী
    আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি
    আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়
    আমি অজয় অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
    আমি মানব দানব দেবতার ভয়
    বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়
    জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য
    আমি তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল-মর্ত্য
     
    আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ
    আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধা
    আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
    নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার
    আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
    আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে
    মহা- বিদ্রোহী রণ-কাল্ত
    আমি সেইদিন সব শান্ত
    যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দণ-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
    অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
    বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত
     
    আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন
    আমি স্রষ্টা-সুদন; শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন
    আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন
    আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন
    আমি চির-বিদ্রোহী-বীর
    আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির