বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে,
চলে যায় তারা কলরবে,
কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়
যৌবনের শ্যামল গৌরবে।
ভালোবাসি, কাছে ডাকি, নামও সব জেনে রাখি,
দেখাশোনা হয় নিতি-নিতি,
শাসন-তর্জন করি শিখাই প্রহর ধরি,
থাকে নাকো, হায়, কোনো স্মৃতি!
ক-দিনের এই দেখা— সাগর সৈকতে রেখা
নূতন তরঙ্গে মুছে যায়
ছোট-ছোট দাগ পার ঘুচে যায় একাকার
নব-নব পদ-তাড়নায়
জানে না কে কোথা যাবে, জোটে হেথা তাই ভাবে
পাঠশালা — যেন পান্থশালা,
দু-দিন একত্রে মাতে, মেলে-মেশে, বসে গাঁথে
নীতি-হার আর কথা-মালা।
রাজপথে দেখা হলে কেহ যদি গুরু বলে
হাত তুলে করে নমস্কার,
বলি তবে হাসিমুখে — “বেঁচে-বর্তে থাকো সুখে,”
স্পর্শ করি কেশগুলি তার।
ভাবিতে-ভাবিতে যাই— কি নাম? মনে তো নাই,
ছাত্র ছিল কত দিন আগে;
স্মৃতি সূত্র ধরি টানি, কৈশোরের মুখখানি
দেখি মনে জাগে কি না জাগে।
ঘন-ঘন আনাগোনা কতদিন দোখাশোনা,
তবু কেন মনে নাহি থাকে?
“ব্যক্তি” ডুবে যায় “দলে”, মালিকা পরিলে গলে
প্রতি ফুলে কে বা মনে রাখে?
এ জীবন ভেঙে-গড়ে শ্যামল-সরস করে
ছাত্রধারা বয়ে চলে যায়,
ফেনিলতা-উচ্ছলতা হয়ে যায় তুচ্ছ কথা,
উত্তালতা সকলি মিলায়।
স্বচ্ছতায় শুধু হেরি আমার জীবন ঘেরি
ভাসে শুধু ম্লান মুখগুলি;
ভুলে যাই হট্টগোল অট্টহাসি-কলরোল,
ম্লান মুখ কখনো না ভুলি।
কেহ বা ক্ষুধায় ম্লান, কেহ রোগে ম্রিয়মান,
শ্রমে কারো চাহনি করুণ,
কেহ বা বেত্রের ডরে বন্দী হয়ে রয় ঘরে,
নেত্র কারো তন্দ্রায় অরুণ।
কেহ বাতায়ন-পাশে চেয়ে রয় নীলাকাশে
যেন বদ্ধ পিঞ্জরের পাখি,
আকাশে হেরিয়া ঘুড়ি মন তার যায় উড়ি,
মুখে কালো ছায়াখানি রাখি।
স্মরিয়া খেলার মাঠ কেউ ভুলে যায় পাঠ,
বুদ্ধিতে বা কারো না কুলায়,
কেহ স্মরে গেহকোণ, স্নেহময় ভাইবোন —
ঘড়ি-পানে ঘন-ঘন চায়।
ডাকিছে উদার বায়ু লয়ে স্বাস্থ্য লয়ে আয়ু,
ডাক শোনে বসে রুদ্ধ ঘরে,
হাতে মসি, মুখে মসি, মেঘে ঢাকা শিশু-শশী—
প্রতিবিম্বে মোর স্মৃতি ভরে।
আর সবি গেছি ভুলি, ভুলিনি এ মুখগুলি,
একবার মুদিলে নয়ন
আঁখিপাতা ভারি-ভারি, ম্লান মুখ সারি-সারি
আকুল করিয়া তোলে মন।