ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলার সব থেকে কম বয়সের বিধায়কের নাম নিয়ে বিধানসভায় মন্ত্রী-বিধায়কদের এক আড্ডায় কথাটা উঠেছিল। তাতে গত কয়েকটি মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম সামনে উঠতেই প্রথম আলোচনায় ওঠে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নাম। ১৯৭২-এর মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রী। এবার বাগদা উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুর জিতে গেলে, সেই রেকর্ড ভেঙে যাবে। বাগদা তৃণমূল পুনর্দখল করতে পারলে ২৫ বছর এক মাস বয়সের মধুপর্ণা হবেন বিধানসভার সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক।
যে আড্ডায় এসব নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেখানে এর পরেই প্রশ্ন উঠল তৃণমূল শেষ লোকসভা ভোটে কত ভোট পেয়েছে। ২০১১, ২০১৬-য় পরপর তৃণমূলের জয়ের পর ২০২১-এ এই আসন জিতে নেয় বিজেপি। ২০২৪-এর বনগাঁ লোকসভার ভোটে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলের হয়ে লড়ে বিশ্বজিৎ দাস এই বাগদা থেকে পেয়েছিলেন ৯২ হাজারের কিছু বেশি ভোট। বিজেপির শান্তনু ঠাকুর পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ১২ হাজার ৭০০ ভোট। তৃণমূল পিছিয়ে ২০ হাজারের কিছু বেশি ভোটে। আর পঞ্চায়েত ভোটের ফল? তেইশের পঞ্চায়েত ভোটে বাগদা ব্লকের ১২টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বিজেপির দখলে যায় মাত্র ৩টি। এই দুই ফল দেখেই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব দেন বারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিককে।
স্থানীয় রিপোর্টের কথা তুলে পার্থ বলেছিলেন, “এবার লড়াই জিততে হলে নতুন ঝকঝকে মুখ দরকার। পুরনো ঝগড়া, ঠেলাঠেলি ছাড়িয়ে মানুষের উন্নয়নকে সামনে রেখে লড়াই করবে এমন জনপ্রতিনিধির কথা ভাবতে হবে। স্থানীয়দের দাবি নিয়ে আলোচনা চলছে।” তখন ঠাকুরবাড়ির সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে বসে মধুপর্ণা ঠাকুর। বড়মা বীণাপাণি দেবীর ঘরে তালা লাগিয়ে তাঁর মা রাজ্যসভার সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের প্রবেশ আটকেছেন শান্তনু ঠাকুর, এই অভিযোগে মধুপর্ণার আন্দোলন চলছিল। এর আগে রাজনীতিতে না থাকলেও এই আন্দোলনে তাঁর জেদ সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়। তাঁর হাতেই তাই বাগদা পুনর্দখলের ভার তুলে দেয় তৃণমূল। ইতিমধ্যেই তাঁর হয়ে প্রচার সেরেছেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সায়নী ঘোষ, ফিরহাদ হাকিম, পার্থ ভৌমিক, নারায়ণ গোস্বামী, রথীন ঘোষের মতো দলের তাবড় মন্ত্রী-সাংসদরা। জেলায় যে কোর কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছে, তারা মূলত এই ভোটের জন্য ছোট ছোট কর্মিসভায় নজর দিয়েছেন। সেই কোর কমিটির অন্যতম সদস্য বিধানসভা মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষের কথায়, “বাগদা ব্লকের প্রত্যেক পকেটে একাধিক ছোট ছোট সমস্যা রয়েছে। সেসব ধরে ধরে আলোচনা করা হচ্ছে। যেসব নিয়ে কথা বলতে আমাদের দলের নেতারা যাচ্ছেন। প্রত্যেক পকেটে ছোট ছোট সভা হচ্ছে।”
বেশ কয়েকটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে এলাকার মহিলাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কিছু সমস্যার পাশাপাশি মতুয়া সম্প্রদায়ের কিছু দাবিদাওয়া রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এনআরসির ভয় এখনও রয়েছে। এই ফ্যাক্টরকে সামনে রেখে লোকসভ ভোটে বিজেপি প্রচারে নেমে বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। যার জেরে সেসব নিয়ে একেবারে ব্যাকফুটে বিজেপি। উলটোদিকে উন্নয়নের ইস্যু তো তৃণমূল প্রার্থীর দিক থেকে রয়েছেই। তার মধ্যে বিজেপির প্রার্থী বিনয় বিশ্বাসকে নিয়ে বড় কোন্দল সবার সামনে এসেছে। সেখানে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের কথা মানা হয়নি, এই অভিযোগে সেখানকার বিজেপির একটি গোষ্ঠী সত্যজিৎ মজুমদার নামে আরেক প্রার্থীকে নির্দল দাঁড় করিয়েছে। ফলে এই ক্ষেত্রেও বিজেপি ব্যাকফুটে বলে দাবি করছে তৃণমূল নেতৃত্ব। তবে বিজেপির দাবি, কোনও কোন্দল নেই। বিজেপি বনগাঁ লোকসভায় জিতেছে, বাগদা উপনির্বাচনেও এই আসন দখলে রাখবে।
অন্যদিকে, কংগ্রেসের দাবি, এই কেন্দ্রে তারাই একমাত্র ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করেছে। বিজেপি আর তৃণমূলের প্রার্থীদের কেউই স্থানীয় নন। কংগ্রেসের প্রার্থী অশোক হালদার পেশায় শিক্ষক, স্থানীয় ব্লকের নেতা। এদিকে এই আসনে প্রার্থী নিয়েই বাম-কংগ্রেসের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়নি। ফরওয়ার্ড ব্লক এক সময় এই কেন্দ্রে জিতত, সেই দাবিকে সামনে রেখে প্রার্থী দিয়েছে তারাও। এই আসনে তাদের প্রার্থী গৌরাদিত্য বিশ্বাস। সিপিএম এই আসন নিয়ে কংগ্রেস আর ফব-র মধ্যে সমঝোতা না করাতে পারার ফলে এই কেন্দ্রকে ঘিরে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি লড়াই। হেলেঞ্চা বাজারে প্রচারে বেরিয়ে আবার সৌজন্যের নজির গড়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্ণা। কংগ্রেস প্রার্থী অশোক হালদারের সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন মধুপর্ণা। বলেছিলেন, “উনি আমার বাবার মতো।” আশীর্বাদও করেছিলেন অশোক। ফলে একদিকে সৌজন্য, শিক্ষা, অন্যদিকে, জেদ ধরে রাখা আন্দোলন, তার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির প্রতিনিধিত্ব। আর সর্বোপরি এলাকার মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে সব দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলই।