সম্যক খান, মেদিনীপুর: পালে হাওয়া লাগানো দূরের কথা পাল তোলারই ক্ষমতা নেই, এই অবস্থায় ভাঙা নৌকার নাবিকেরও ডোবার অবস্থা তার ব্যক্তিগত কৃতকর্মের জেরে। নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোয় পদ হারানোর মুখে সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক মহিলার সঙ্গে বছরের পর বছর সহবাসের অভিযোগ উঠল তাঁর বিরুদ্ধে। ওই মহিলা দলের রাজ্য সম্পাদকের কাছে তাঁদের সম্পর্কের সমস্ত প্রমাণ-সহ লিখিত অভিযোগ করেন। শুরু হয়েছে তদন্ত। বিশেষ সূত্রের খবর, দলের রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সুশান্তবাবুকে পদত্যাগ করার নির্দেশও নাকি দেওয়া হয়েছে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুশান্তবাবু। তিনি বলেন, “পরিকল্পিতভাবে চরিত্রহনন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা বলার তা দলের রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েছি।” সামনে দলের সাংগঠনিক সম্মেলন। তার আগে এমন অভিযোগের নেপথ্যে দলেরই এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
বিগত বামফ্রন্ট আমলে ডাকাবুকো মন্ত্রী তথা নেতা ছিলেন সুশান্ত ঘোষ। গড়বেতা থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার কথাই ছিল শেষ কথা। ২০১১ সালে পালাবদলের পর তিনি কঙ্কালকাণ্ডে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। জামিন পেলেও দীর্ঘদিন নিজের জেলায় ঢুকতে পারেননি। তিন বছর আগে জেলায় ফেরার অনুমতি পান। থাকতে শুরু করেন চন্দ্রকোনা রোডের নিজের বাড়িতে। জেলায় ফিরে আসার পরই গত পার্টি সম্মেলনে ২০২২ সালে তিনি ভোটাভুটিতে তাপস সিনহাকে হারিয়ে দলের জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। সামনের বছর আবার পার্টির সম্মেলন শুরু হচ্ছে। তার নির্ঘন্টও প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। ঠিক তার আগেই সুশান্ত ঘোষের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ।
চন্দ্রকোণা রোডেই আদি বাড়ি ওই মহিলার। বর্তমানে তিনি রাজ্য সরকারের এক দপ্তরের কর্মচারী। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে থাকেন মেদিনীপুর শহরেরই আবাসে। নির্যাতিতার দাবি, ২০০৬ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে সুশান্তবাবুর। তখন সুশান্ত ঘোষ ছিলেন পরিবহণ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই মহিলার কথায়, “চাকরির অনুরোধ নিয়ে প্রথমে বাবার সঙ্গে তৎকালীন মন্ত্রীর বাড়িতে যাই। অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। পরে একদিন আবার চন্দ্রকোণা রোডে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠান। সেদিন নিজের বাড়িতেই জোর করে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করেন। চুপচাপ থাকার পরামর্শ দেন। মুখ খুললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।” মহিলার আরও দাবি, এর পর মাঝেমধ্যেই সুশান্তবাবু তাঁর সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হন।
ওই মহিলা রেল কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে হয়। সে বিয়ে ভাঙার জন্য তৎকালীন মন্ত্রীকেই দায়ী করেন ওই মহিলা। বিয়ের পরও সুশান্তবাবু তাঁকে শারীরিক সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করেন বলেই অভিযোগ। মহিলার দাবি, বিবাহবিচ্ছেদের পর সুশান্তবাবু তাঁকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে সে কথাও রাখেননি। তবে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তাঁদের সম্পর্ক ছিল বলেই দাবি। তবে তার পর অন্য এক বিধবা মহিলার নাকি প্রেমে পড়েন সুশান্ত ঘোষ। সে কারণে অভিযোগকারী ওই মহিলার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখছেন না। ‘প্রতারিত’ মহিলা তাই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট, নিজেদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি, ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ প্রমাণ হিসাবে দাখিল করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের কাছে অভিযোগ জানান। দলীয় সূত্রের খবর, ওই মহিলার কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর এক মহিলা-সহ দুই সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। তাঁরা গত জুন মাসে মেদিনীপুর এসে অভিযোগকারী মহিলার সঙ্গে কথাও বলেন। কথা বলেন অভিযুক্ত জেলা সম্পাদক সুশান্ত ঘোষের সঙ্গেও। এমনকি এনিয়ে কথা বলতে দলের রাজ্য দপ্তরেও সুশান্তবাবুকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল।
মহিলার অভিযোগ অস্বীকার করলেও ওই মহিলাকে অবশ্য চিনতে পারেন সুশান্তবাবু। তিনি জানান, মন্ত্রী থাকাকালীন অনেকেই চাকরিতে সুপারিশের অনুরোধ নিয়ে আসতেন। সেরকম ওই মহিলা এসে থাকতে পারেন। তবে তিনি তাঁর চাকরি করে দেননি। তাঁর কথায়, “২০০৬ সালে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে আর অভিযোগ তোলা হচ্ছে ২০২৪ সালে। দীর্ঘ ১৮ বছর পর এধরনের অভিযোগ তোলার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যখন মন্ত্রী ছিলাম তখন না হয় প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠতে পারত। তার পর জেলযাত্রা থেকে শুরু করে বছরের পর বছর জেলার বাইরে থাকা। ফিরে এসে কঠিন পরিস্থিতিতে জেলা সম্পাদক হওয়ার সময়ও কোনও অভিযোগ উঠল না। সারাজীবন মাথা উঁচু করে রাজনীতি করেছি। আর্থিক দুর্নীতি ও চরিত্র নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি। অথচ সম্মেলন যখন দোরগোড়ায় তখন তাকে চারিত্রিকভাবে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা চলছে। আজকের প্রযুক্তির যুগে ফেক ছবি, ভিডিও, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট তৈরি করা কঠিন কিছু নয়। কেউ কী তাঁর বেডরুমে সিসিটিভি লাগিয়ে রাখেন?” সুশান্তবাবু আরও বলেন, “যা জানানোর আমি জানিয়ে এসেছি। এখন দল যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেভাবেই চলবে।”