অর্ণব দাস, বারাকপুর: এতদিনে অনেককে মেরেছি, খুন করিয়েছি। আমি জানি একদিন আমাকেও এমনই নির্মম, নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। জেরার মুখে ঠান্ডা অথচ কাটা কাটা স্বরে এই কথাগুলিই পুলিশকে জানায় গোল্ডেন ডাকু সুবোধ সিং। শানিত বুদ্ধি, তুখড় প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং অসম্ভব ঠান্ডা মাথা। সাদাকালোর মিশেলে এমনই কুখ্যাত গ্যাংস্টার সুবোধ সিংয়ের চরিত্র। একদিকে সে গোল্ডেন ডাকু, পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড দুষ্কৃতী, অন্যদিকে আবার তার কথাবার্তায় ফুটে ওঠে যেমন কর্ম, তেমন ফল গোছের ভাবও। তবে চেহারায় অনুতাপ বা আক্ষেপের লেশমাত্র নেই। নিজের অপরাধ নিয়ে অকপট সুবোধ পুলিশের কাছে নিজের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করে না। অন্যদিকে, পুলিশের সামনেই সে বলে, যে তার বিরুদ্ধে যায়, তাকেই সে টার্গেট করে। সুবোধ জানায়, পুলিশের সঙ্গে তার কোনও লড়াই নেই। সবমিলিয়ে সুবোধকে জেরা করতে গিয়ে দুঁদে গোয়েন্দারাও কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত।
প্রথমে বেলঘরিয়া (Belgharia) থানায় পুলিশি হেফাজত তারপর কয়েকদিন জেল হেফাজত কাটিয়ে ফের পাঁচদিন মোহনপুর থানায় পুলিশি হেফাজত হয়েছিল সুবোধ সিংয়ের। যদিও তিনদিনের পুলিশ হেফাজতের পরেই শুক্রবার তাকে তোলা হয় বারাকপুর আদালতে। এই প্রসঙ্গে সুবোধের আইনজীবী কমলজিৎ সিং বলেন, “পুলিশি হেফাজতে কেসের কোনও ডেভেলপমেন্ট না হওয়ায় এদিন সুবোধ সিংকে আদালতে পেশ করা হয়েছে। তদন্তকারী অফিসার বারাকপুরের (Barrackpore) প্রসিদ্ধ বিরিয়ানি ব্যবসায়ীকে হুমকিতে ফোনের অভিযোগে তাঁর কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের জন্য আবেদন করেন। বিচারক আগামী ২৩ তারিখে কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দেন। ততদিন সে জেল হেফাজতে থাকবে।”
দীর্ঘদিন বারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের (Police Commissionarate) বিভিন্ন থানায় থাকলেও একটুও ভেঙে পড়েনি সে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বভাবগতভাবে শান্ত সুবোধ ঠান্ডা মাথাতেই পুলিশের জেরার সব উত্তর সে দিয়েছে। উলটে তদন্তকারীদের সে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, পুলিশ তার বন্ধু। বারাকপুর ওয়্যারলেস গেট সংলগ্ন একটি প্রসিদ্ধ বিরিয়ানি দোকানের মালিকের ছেলেকে গত বছরের নভেম্বর মাসে হুমকির অভিযোগে গত মঙ্গলবার মোহনপুর থানায় পুলিশ হেফাজত হয় সুবোধ সিংয়ের। এই ঘটনার তদন্তে পুলিশকে বিরক্ত নয়, বরং তদন্তে সে সহযোগিতাই করছে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই অনুতাপ বা অপরাধবোধ যে সুবোধের নেই তার আচরণেই সেটা স্পষ্ট বলেই জানা গিয়েছে। কিন্তু, কেন এমন আচরণ? পুলিশকর্তাদের কথায়, তার কাছে অপরাধ (Crime) করা, জেলযাত্রা আর পাঁচটা কাজকর্মের মতো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই এমন আচরণ।
সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, তদন্তকারীদের সে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, পুলিশকে সে শ্রদ্ধা করে। পুলিশের সঙ্গে তার লড়াই নেই, অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গেই তার লড়াই। কেউ সুবোধের বিরুদ্ধে গেলেই সে তাঁর বিরুদ্ধে যায়। একইসঙ্গে পুলিশকে সে এও বলেছে যে, যেভাবে সে এতদিন অনেককে মেরেছে, খুন করিয়েছে, তেমনই নির্মমভাবে তাকেও একদিন মরতে হবে! যদিও তার মুখে এমন নীতিবাক্য শুনে পুলিশের বক্তব্য, এটা আসলে ধূর্ত সুবোধের পুলিশের সহানুভূতি পাওয়ার ছক। তবে, হুমকির যে ঘটনার তদন্তে মোস্ট ওয়ান্টেড এই দুষ্কৃতীকে মোহনপুর থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল, সেই হুমকির ফোন সে করেনি বলেই বারবার জেরায় জানিয়েছে বলেই খবর।
শুক্রবার তাকে বারাকপুর আদালতে নিয়ে আসা হলে সংবাদমাধ্যমের সামনেও একই কথা জানায় সুবোধ। তাঁর কথায়, “ফোনে হুমকির অভিযোগ মিথ্যা। এই সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আমাকে টাকা দিয়েছে এমন কোন ব্যবসায়ী মিডিয়ার সামনে এসে প্রমাণ দিক।” একইসঙ্গে হুমকির ফোন আসা বারাকপুরের আরেক ব্যবসায়ী তাপস ভকত প্রসঙ্গে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে সে জানায়, ”তাপস আমার সঙ্গে দেখা করতে পাটনা কোর্টে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে সে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিল।” যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে তাপস ভকত বলেন, ”এর আগে সুবোধ মিডিয়ায় নিজে বলেছে আমাকে চেনে না। ও নিজেও স্বীকার করেছে হুমকির ফোন রোশন যাদবকে দিয়ে করিয়েছে। আমি পুলিশের কাছে অভিযোগে জানিয়েছি ২০২২সাল থেকে সুবোধ সিং আমাকে হুমকি দিচ্ছে। এড়িয়ে যাচ্ছিলাম বলেই ২০২৩ সালে আমার রেস্টুরেন্টের সামনে বোমাবাজিও করিয়েছিল। যদি আমার সঙ্গে ওর পরিচয় থাকে তাহলে কেন ফোনে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। ওর কাছে কোনও প্রমাণ থাকলে মিডিয়ার সামনে আনুক।”