• নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে একাই আগলে রাখলেন বানভাসি গ্রাম
    বর্তমান | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • রাজদীপ গোস্বামী, কেশপুর: গ্রামের ভিতরে হু হু করে ঢুকছে জল। প্রখর স্রোতের টানে সবকিছু ভেসে যাচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যেই গোটা গ্রাম চলে যায় জলের তলায়। প্রাণ বাঁচাতে ভিটে মাটি ছেড়ে পালাতে থাকেন সকলেই। নিরাপদ আশ্রয় বলতে উঁচু বাঁধ। নৌকায় চেপে সেখানেই চলে যান গ্রামবাসীরা। সঙ্গে যে যেমন পেরেছেন শুকনো খাবার নিয়েছেন। এই যেমন মুড়ি, চিঁড়ে প্রভৃতি। কেউ কেউ পোষ্যদের নিয়েছেন। সোনা-দানা, বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার মতো সময় দেয়নি জলের স্রোত। সবার ভয়টা ছিল এখানেই। দুষ্কৃতীরা রাতে এসে লুটপাট চালাবে না তো! সবাই যখন বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে এমন প্রশ্নে উদগ্রীব, তখন নিজের জীবন বাজি রেখে গ্রাম পাহারা দিলেন পঞ্চায়েত সদস্যা অসীমা হালদার। একজন মহিলা হয়েও তিনি যেভাবে আগলে রাখলেন গ্রামকে, তা এককথায় অভাবনীয়। অসীমাদেবীর সাহসকে কুর্নিশ করেছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা। কেশপুর ব্লকের এনায়েতপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কাপাসটিকরি গ্রাম থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অসীমাদেবী। জল ঢুকেছে তাঁর বাড়িতেও। চাইলে তিনিও পালাতে পারতেন। কিন্তু যাননি। ঘরের ভিতর একটি খাট ছিল তাঁর আশ্রয়স্থল। সেখানে ঠায় বসে ছিলেন টানা তিনদিন। খিদে মিটিয়েছেন শুধুমাত্র মুড়ি খেয়ে। দিনের বেলা খাটে বসে কিছু সময় বিশ্রাম। গোটা রাত জেগে থাকা। ‘পাছে দুষ্কৃতীরা গ্রামে ঢুকে লুটপাট চালায়। এই আতঙ্কে ঘুমই আসত না আমার চোখে।’—বলছিলেন অসীমাদেবী। তাঁর সাহসী নজরদারিতে গ্রামে কোনও অঘটন না ঘটলেও বন্যা গিলেছে অনেককিছুই। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব কষতে বসে মাথায় হাত পড়েছে গ্রামবাসীদের।  


    এদিন কথা হচ্ছিল গ্রামের বাসিন্দা লক্ষী হালদার, জয়া হালদার, ছবি দাসের সঙ্গে। তাঁরা বলছিলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতে সকলেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। বাঁধের উপর তাবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করেছি। তবে, মনটা বাড়িতেই ছিল। কারণ বাড়ির জিনিস পত্র বিশেষ নিয়ে আসতে পারিনি। অসীমাদি গ্রামে থাকায় কোনও দুশ্চিন্তা হয়নি। ওঁর সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানাচ্ছি।’ 


    কাপাসটিকরি গ্রামের পাশ দিয়েই গিয়েছে কংসাবতী। ফি বছরই এই কংসাবতীর জলে বানভাসি হন গ্রামবাসীরা। তবে, এবারের বন্যার ভয়াবহতা অনেকটাই বেশি। বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে এই গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যান গ্রামবাসীরা। জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা গ্রাম চলে যায় জলের নিচে। গ্রামবাসীরা একে একে চলে যান নদী বাঁধে। অসীমাদেবীর স্বামী মেঘনাদ ও ছেলে পঙ্কজও চলে যান। অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে ত্রিপল খাটিয়ে মেঘনাদও থাকতে শুরু করেন। স্বামী ও ছেলে বারবার অসীমাদেবীকে যেতে বললেও তিনি শুনতে চাননি। বাড়িতে থাকা একটি খাটের উপর আশ্রয় নেন পঞ্চায়েত সদস্যা। ছেলে পড়ার বই দড়ি দিয়ে বেঁধে উপরে তুলে দেন। খাবার বলতে ত্রাণের মুড়ি। জানা গিয়েছে, বর্তমানে গ্রামের মানুষ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু মাটির  বাড়ির একাংশ  ভেঙে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে গ্রামবাসীদের। বাড়িতে সাপ, ব্যাঙ আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামে চাষ হওয়া ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 


    এদিন অসীমাদেবী বলেন, ‘তিন দিন খাটের উপর বসেছিলাম। ঘরের ভিতর এক কোমরের কাছাকাছি জল ছিল। খাটটি ডুবে যায়নি। খুব কষ্ট হয়েছে। ঘরের ভিতরে সাপ ঢুকে আসতে দেখেছি। লাঠি দিয়ে তাড়িয়েছি। গ্রামের ভিতর নৌকা নিয়ে কারা ঢুকছে, নজর রাখতাম। তাই কিছু জিনিস পত্র ভেসে গেলেও চুরি হয়নি।’ 


    তৃণমূলের ব্লক সভাপতি প্রদ্যৎ পাঁজা বলেন, গ্রামবাসীদের পাশে প্রশাসন ও দল সর্বদা আছে। দ্রুত মানুষের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চলছে।  নিজের বাড়িতে অসীমা হালদার।-নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)