পলাশির যুদ্ধের আগে শুরু উমা আরাধনা, ইতিহাস কথা বলে ফলতার এই বাড়ির পুজোয়!
প্রতিদিন | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সুরজিৎ দেব, ডায়মন্ড হারবার: ইতিহাস সত্যিই কথা বলে! প্রায় ৩৫০ বছর আগের সেই ইতিহাস। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতার মালা গ্রামের দেবসরকার বাড়ির প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরে পরতে পরতে তার একাধিক প্রমাণ। কালের নিয়মে যে ইতিহাস আজ বিবর্ণপ্রায়। দেবী দুর্গার আরাধনায় ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে সেই বনেদিয়ানার পরিচয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছে দেবসরকার পরিবার।
তৎকালীন জমিদার দেবসরকারদের বাড়ির দুর্গাপুজোর শুরু পলাশির যুদ্ধের সময়কালেরও বেশ কয়েক বছর আগে। সেই পুজো এবার ২৮০ বছরে পড়ল। পুজো উপলক্ষে দেবীর আবাহনের প্রাক্ প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে জমিদার বাড়িতে। পুজোর ইতিহাসে আসার আগে আরও কিছুটা সময় এগিয়ে যাওয়া যাক। দেবসরকারদের জমিদারি ছিল কলকাতা থেকে সুদূর সুন্দরবনের লাট অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। গাঙ্গেয় জমিতে ধানের ফলন হত বেশ ভালোই। আর সেজন্যই ফলতায় গড়ে উঠেছিল বিশাল এক ধানের আড়ত। ধানের ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ওই এলাকা।
আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের এক সদস্য বিহারীলাল দেব প্রথম ফলতার মালা গ্রামে আসেন সেই ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই। একসময় একইসঙ্গে ফুলেফেঁপে ওঠে দেব দের জমিদারি ও ব্যবসা। সমাজের বহু উঁচুতলায় যাতায়াত গড়ে ওঠে দেব পরিবারের সদস্যদের। লাটসাহেবদের সঙ্গেও ছিল দারুণ সখ্যতা। সেই সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একসময় দেব পরিবারকে সরকার উপাধিতে ভূষিতও করে।
দেবসরকার বাড়ির সদস্য শুভ্র দেবসরকার জানান, ব্যবসায়িক কাজে কলকাতা থেকে মালা গ্রামে এসে গ্রাম্য প্রকৃতির মায়ায় আবদ্ধ হন বিহারীলাল দেব। মালা নিবাসী নাগ বংশের কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর পর মালা গ্রামেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। গ্রামে নিজের তৈরি রাজপ্রাসাদের মত বাড়িতে বসে জমিদারি ও ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করতেন বিহারীলাল। বাড়ির চারদিক ছিল জলাশয়ে ঘেরা। কেবল সামনের অংশটুকুই ছিল উন্মুক্ত। শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতেই এমন বাড়ি তৈরি করেছিলেন তিনি। বিহারীলালই সেখানে মন্দির নির্মাণ করে কুলদেবতা শ্রী শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন জিউর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে দেবসরকার বাড়ির যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বিপ্লবীদের অবাধ যাতায়াত ছিল দেবসরকার বাড়িতে। জমিদার বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আশ্রয় নিতেন বিপ্লবীরা। তাঁদের চিকিৎসার ব্যয়ভারও বহন করত দেবসরকার পরিবার। দেবসরকার পরিবারের তৎকালীন সদস্য ডা: অশ্বিনী কুমার দেবসরকার ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। এর জন্য বহুবার কারাবাসও করতে হয়েছে ডাক্তারবাবুকে। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে এলাকায় ছিল তাঁর বিশেষ ভূমিকা।
এমনই এক পরিবারে বাংলার ১১৫২ সালে প্রথম শুরু হয় অসুর নিধনে দুর্গার আরাধনা। বিহারীলালের পুত্র কালীকৃষ্ণ দেবসরকার জমিদার বাড়িতে প্রথম আয়োজন করেন দুর্গাপুজোর। সেসময় পুজোয় সাতদিন ধরে চলত যাত্রাপালা ও কবিগান। মহিলাদের মনোরঞ্জনে আলাদা ব্যবস্থা থাকত বাড়ির ভিতর মহলে। ইংরেজ সাহেবরাও নিমন্ত্রিত থাকতেন দেবসরকার বাড়ির দুর্গোৎসবে। শোনা যায়, চারণকবি মুকুন্দ দাস নাকি একবার পালাগান করতে এসেছিলেন এই দেবসরকার বাড়িতে।
প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর পরদিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন প্রাচীন কালের সেই কাঠামোতে পুজো দিয়ে শুরু হয় দেবীর আবাহন। তার পর একে একে খড় বাঁধা ও মাটির প্রলেপে একচালার মৃন্ময়ী মূর্তি চিন্ময়ী রূপ নেন। একটি সুপ্রাচীন বেলগাছের তলায় হয় দেবীর বোধন। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত ১৩১ কেজি চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয় দেবীকে। পুজোয় বহু প্রাচীন বলিদান প্রথার প্রচলন আজও রয়েছে। দেওয়া হয় পাঁঠাবলি। আগে বংশপরম্পরায় মল্লিকপুরের চক্রবর্ত্তী পরিবার এই দেব সরকার বাড়ির কুলপুরোহিত ছিলেন। পরবর্তীকালে বেলসিংহার মৈত্র পরিবার দেবসরকার পরিবারে পুজোর দায়িত্ব নেয়। মৃৎশিল্পী, ঢুলিদার সকলেই বংশপরম্পরায় জমিদার বাড়ির এই পুজোয় নিজ নিজ কাজে অংশ নেয়।
গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য পুজোয় জমিদার বাড়ির অবারিত দ্বার। দেশ-বিদেশে কর্মরত পরিবারের সদস্যরাও পুজোর সময় গ্রামে ফেরেন। ক’দিন ধরে দেবসরকার বাড়িতে তখন শুধুই গান খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দ। নবমীর আনন্দ সন্ধায় প্রতিবারের মতো এবারও দেব সরকার বাড়িতে থাকছে কিছু বিশেষ চমক। তবে কি সেই চমক তা আগে থেকে ফাঁস করতে রাজি নন পরিবারের সদস্যরা। পুজোয় আগের সেদিনের সেই জৌলুস আজ আর নেই। তবে পূর্বপুরুষদের সময়কার সেই পুরোন ঐতিহ্য ও রীতিনীতি মেনেই বংশের নবম পুরুষ এবারও ব্রতী দুর্গা আরাধনায়। পরিবারের আট থেকে আশি সকলেই এখন দিন গুনছেন উমার আগমনের অপেক্ষায়।