কিংশুক প্রামাণিক: বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন আগামী বছর ৫-৬ ফেব্রুয়ারি। তার আগে প্রস্তুতি বৈঠকেই বোঝা গেল, এবারের সম্মেলন কতটা সফল হতে চলেছে। একদিকে বিভিন্ন দেশের কনসাল জেনারেলরা, অন্যদিকে রাজ্যের প্রধান শিল্পকর্তাগণ। মধ্যমণি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। নিউ আলিপুরে সরকারি অতিথিশালা ‘সৌজন্যে’ শুক্রবারের সন্ধ্যাটা বাংলার জন্য হয়ে উঠল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আবার দেখা গেল, রাজ্য তথা দেশের শিল্পমহল কতটা ভরসা করেন তৃণমূল নেত্রীকে। সবার সেই সমর্থন পাশে নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা ‘বাংলা হবে সোনার খনি’।
স্থায়িত্ব এবং লগ্নির পরিবেশ ? এটাই যে বাংলা সম্পর্কে তাদের আগ্রহ দিনকে দিন বাড়িয়েছে, সেকথা এদিনও আরও একবার বলে দিলেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, হর্ষ নেওটিয়া থেকে শুরু করে রিলায়েন্স, বিড়লা, আইটিসি, ইমামি, চর্মশিল্পের মতো বড় বড় সংস্থার শিল্পসংস্থার কর্তারা। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ”ক্ষুদ্রশিল্পে আমরা নম্বর ওয়ান। বাংলায় এত ব্যবসা হচ্ছে যে কোনও হোটেলে জায়গা নেই। হোম স্টে-তে বিপ্লব হয়ে গিয়েছে। আইটি সেক্টরে ইনফোসিসের মতো সংস্থা আবার বিনিয়োগ করবে। বাংলা এখন লগ্নির সেরা গন্তব্য। সব কিছুতে রাজ্য এখন এগিয়ে গিয়েছে। আপনারা সবাই আরও লগ্নি করুন। সরকার পাশে আছে।”
প্রসঙ্গত, ১৮ ডিসেম্বর নিউটাউনে ইনফোসিসের নতুন দপ্তরের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন মুখ্যমন্ত্রী একইসঙ্গে গুরুত্ব দিলেন আমেরিকা ও জাপানের প্রতিনিধির বক্তব্যে। কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল জানালেন, বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে আমেরিকা থেকে একটি বড় বাণিজ্যিক দল আসবে। বাংলাকে লগ্নির জায়গা হিসাবে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। অনুষ্ঠানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানালেন, জাপান সম্ভবত এবারের সম্মেলনের থিম কান্ট্রি হতে যাচ্ছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে আবার আসছেন বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দিতে। যথারীতি এবারে জোর দেওয়া হচ্ছে ক্ষুদ্রশিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ভ্রমণ, হোটেল, হোমস্টে, চর্মশিল্প-সহ কর্মসংস্থানমুখী বিষয়কে। এদিনের প্রস্তুতি বৈঠকে সেই কথাগুলি বারবার উচ্চারিত হল।
সাড়ে চারটের সময় ঘরোয়া আলোচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রস্তুতি বৈঠক। সবাইকে ডাকা সম্ভব হয়নি। মূলত শীর্ষ শিল্পকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থিতি অবশ্য বাড়তি মাত্রা যোগ করে। তিনি জানালেন, তাঁর তৃতীয় ইস্পাত কারখানা শীঘ্রই সামনে আসবে। তিনি বলেন, ‘‘আমি ক্রিকেটার। কিন্তু আমাদের পরিবার ব্যবসায়ীর পরিবার। তবে সঞ্জীবদের মতো অত বড় নয়। আমি ক্রিকেট খেলে ৪০০ টাকা পেতাম। আর সঞ্জীব দুমাসের জন্য ২৭ কোটি টাকা দিচ্ছে ঋষভ পন্থকে। আসলে খেলাও এখন ব্যবসার অঙ্গ। প্রচুর কর্মসংস্থান সেখানেও হয়।’’
প্রথমেই বক্তব্য রাখেন আরপিজির কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কা। তিনি বলেন, ‘‘২২টি রাজ্যে আমাদের লগ্নি। কিন্তু সবচেয়ে ভালো পরিবেশ এই পশ্চিমবঙ্গে। আগামী দিনেও আরও লগ্নি করব।’’ ইউনিভার্সাল সাকসেসের প্রধান প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক স্থায়িত্বই লগ্নির দুর্দান্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। আমরা অনেকক্ষেত্রেই ইনভেস্ট করছি।’’ আইটিসি-র সঞ্জীব পুরী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু সংস্কার করেছেন রাজ্যে যেগুলো শিল্পায়নে কাজে লাগবে। দারুণ লগ্নির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলা হয়েছে গন্তব্য।’’ বেঙ্গল অম্বুজা গ্রুপের কর্ণধার হর্ষ নেওটিয়ার কথায়, ‘‘বাংলা আজ সবার গন্তব্য। আমরা নিশ্চিন্তে এই রাজ্যে ব্যবসা করছি। বিপুল কর্মসংস্থান হচ্ছে।’’ টিটাগড় ওয়াগনের উমেশ চৌধুরী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় গুণ, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা গতিশীল সরকার চলছে। এখানে একটি শ্রমদিবসও নষ্ট হয় না।’’ ফিকির প্রেসিডেন্ট হর্ষ আগরওয়াল বলেন, ‘‘বাংলায় আমাদের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে ভালো। মুখ্যমন্ত্রী লগ্নির জন্য নিজে উদ্যোগী।’’ রিলায়েন্স গোষ্ঠীর পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা তরুণ ঝুনঝুনওয়ালিয়া বলেন, ‘‘বাংলায় আমরা ১৫ বছর কাজ করছি। এই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেটা দেখছি তা হল, সরকারের সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ। আমাদের তো মানুষের মধ্যেই কাজ করতে হয়।’’ টেকনো ইন্ডিয়ার কর্ণধার সত্যম রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘দিদি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাই হয়ে উঠেছে ফোকাস।’’
চর্মশিল্পে রাজ্য কীভাবে এগিয়ে চলেছে সেকথা তুলে ধরেন বিশিষ্ট শিল্পকর্তা রমেশ জুনেজা। হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে উত্তরবঙ্গে তাঁদের কাজের তথ্য তুলে ধরেন শিল্পকর্তা দিলীপ দুগার। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের হোমস্টে এবং নতুন নতুন টুরিস্ট স্পট সৃষ্টি করার যে উদ্যোগ মুখ্যমন্ত্রী নিয়েছিলেন, তা সাফল্যের মুখ দেখেছে।’’ অর্থাৎ সমস্ত শিল্পকর্তাই নিজেদের বক্তব্যে তুলে ধরেন, বাংলায় একটি দায়িত্বশীল সরকার কীভাবে লগ্নির পরিবেশ রচনা করে শিল্পে অগ্রগতি ঘটিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে স্বাগত জানান। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ। তিনি জানান, আগামী ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের থিম সং হতে চলেছে মুখ্যমন্ত্রীর গান। বিজিবিএস-এ উদ্বোধনী সংগীত হবে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা গান। তার ইংরেজি ভার্সনও তিনি শোনান। এদিন আমন্ত্রিত ছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, সুজিত বসু, শশী পাঁজা। ছিলেন মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, শান্তনু বসু, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম সান্যাল, উজ্জ্বল সিনহারাও।