• পাথরের লীলাক্ষেত্র, লোককথায় পাথরা
    এই সময় | ১৪ মে ২০২৫
  • গ্রামের নাম পাথরা। না, কংসাবতীর তীরের মন্দিরময় পাথরা নয়। এটি গড়বেতা ১ ব্লকের খড়কুশমা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন শিলাবতী নদীর তীরে গড়ে ওঠা গ্রাম পাথরা। এখানকার সুবিশাল, অপূর্ব পাথরের চাঁইগুলি দেখে চমকে উঠতে হয়। চাঁই না বলে পাহাড়ই বলা চলে। মনে প্রশ্ন জাগে, কী ভাবে সৃষ্টি হলো এই পাথরভূমি?

    গড়বেতা শহরের পূর্বে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি। তার লাগোয়া একটি মিশ্র সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম খড়কুশমা। নানা জনজাতির বসবাস এখানে। এই গ্রামের পরেই মাথুরি গ্রাম। তার এক কিলোমিটার দূরেই বনের মাঝে পাথরা গ্রাম। ১৯৭৮ সালে শিলাবতী নদীতে দু'বার আসা বন্যায় অনেক গ্রামের সঙ্গে শিমুলিয়া গ্রামটিও ভেসে যায়। প্রাণ বাঁচাতে ওই গ্রামের মানুষজন নৌকায় করে পাথরার ডাঙাতে এসে আশ্রয় নেয়। পরে বন্যার জল সরে গেলেও অনেকেই আর শিমুলিয়া গ্রামে ফিরে যায়নি। সে থেকেই গড়ে ওঠে জনবসতির গ্রাম পাথরা।

    আগে পাথরা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। ঘন শাল-মহুয়ার গাছে ভরাট ছিল এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ছিল হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যেই বিরাজ করতেন জাগ্রত এক বনদেবী। এলাকাবাসী তাঁর নাম দিয়েছে 'পাথরাসিনি'। মকর সংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ এই বনদেবীর পুজাকে কেন্দ্র করে বসতো 'পাথরাসিনির মেলা।' দূর থেকে বহু লোকজন পুজো দিতে আসতেন। কিন্তু রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে যেতেন। তখন নাকি বনদেবী পাথরাসিনি রূপ ধরে এখানে আসতেন।

    পাথরাসিনিকে নিয়ে এখানে আরও অনেক লোকশ্রুতি ছড়িয়ে আছে। অনেক পাথরের মধ্যে এখানে গরুর গাড়ির চাকার মতো দু'টি বিশাল আকারের পাথর আছে। তারা একে অন্যের উপরে জড়িয়ে থাকে। জনশ্রুতি আছে, পাথরের চাকা দু'টি একে অন্যকে ছুঁয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে শিলাবতীর জলে নামতে যাচ্ছিল। সামনেই থাকা কয়েকজন রাখাল বালকের মধ্যে একজন তা দেখতে পায়। সে ছুটে এসে ওই পাথরদু'টির উপরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কার্য করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে পাথরদু'টি নিশ্চল হয়ে পড়ে। তখন থেকেই পাথরাসিনির পুজোর চল হয়েছে বলে ধারণা।

    স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায় এই পাথরাসিনির পুজোর ব্যাপারটা ঐতিহাসিক নায়েক বিদ্রোহের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতে পারে। বগড়ীর রাজা ছত্রসিংহের প্রধান সেনাপতি অচল সিং-এর নেতৃত্বে যে নায়েক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়ে তা এই জঙ্গল এলাকাকে ঘিরেই। যার বহু নিদর্শন মালবান্দি, মঙ্গলাপোতা, ফাঁসিডাঙা, গনগনি ডাঙাতে ছড়িয়ে আছে। কারণ ওই সময়ে নায়েক বীররা জঙ্গলের মধ্যে বহু বনদেবীর পূজার প্রচলন করেছিল। মালবান্দি গ্রামে যেমন নায়েক বিদ্রোহের আমল থেকে দেবী ভৈরবীর পূজা হয়ে আসছে তেমনই এখানে এই 'পাথরাসিনি'র পূজার প্রচলনও তারাই করতে পারে বলে অনুমান অনেকের।

    অন্য মতে তারও অনেক আগে থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। কারণ 'সিনি' ঠাকুরের পুজো শুরু হয় জৈনদের সময়ে। তবে, এই পুজো কোনও পৈতেধারী ব্রাহ্মণেরা করেন না। করেন তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির তপসিলি সম্প্রদায়ের নায়েক বা ওই সম্প্রদায়ের মানুহজন। বর্তমানে পাথরা গ্রামে ভালো রকম জনবসতি গড়ে ওঠায় এই 'পাথরাসিনি' বনদেবীর পুজো ভালোভাবেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখন মেলাটি একদিনের বদলে দু'দিন ধরে হয়। মকর সংক্রান্তি এবং তার পরের দিন। জনবসতি গড়ে উঠলেও এই বনদেবীর স্থানটি এখনও বেশ ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। মূল দুটো পাথরকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হয়। দু'দিকে অজস্র মাটির ঘোড়া-হাতি, যা ভক্তরা নিয়ে এসে পুজো দিয়ে যান।

    পাথরাসিনির পুরোহিত ষাটোর্ধ্ব নিমাই মণ্ডল জানান, বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই পুজো করে আসছেন। এখন তাঁরা চন্দ্রকোণা ব্লকের অধীন আকনা গ্রামে থাকেন। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন এখানকার মঙ্গলাপোতা গ্রামের বাসিন্দা। অন্য পুরোহিত বংশীধারী কোটাল খড়কুশমা গ্রামের বাসিন্দা। তাঁরা জানান, এই দেবীকে ঘিরে বহু লোকশ্রুতি ছড়িয়ে আছে। গরু-বাছুর হারিয়ে গেলে এখানকার মানুষজন মানত করেন তা ফিরে পাওয়ার জন্য। এ ছাড়া, সংসারের মঙ্গল কামনায়, শুভ কাজেও দেবীর বর প্রার্থনা করেন তাঁরা। দেবী পাথরাসিনি ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রচুর পাথর। অফুরন্ত সে পাথরভাণ্ডারকে রক্ষা করা প্রয়োজন। যে ভাবে নানা জায়গা থেকে অসাধু উপায়ে পাথর অন্যত্র চলে যাচ্ছে সে জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এই পাথরও অন্যত্র চলে যাবে না তো? তাই এলাকার মানুষের দাবি সরকারিভাবে এই জায়গাটি ঘিরে দেওয়ার ব্যবস্থা হোক। এখানে পাথরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রাজ্যের বিভিন্ন মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে ভালো হয়।

    সত্যিই পাথরার পাথরের অপরূপ লালিমা দেখলেই মন ভরে ওঠে। যেন পাথরের একটা আচ্ছাদন পুরো এলাকা জুড়ে। কিছু কিছু পাথরের খণ্ড নেমে এসেছে চাষের জমির উপর। সামনেই দোমোহনি। এখানে শিলাবতী নদী দু'ভাগ হয়ে গিয়েছে। তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে পশ্চিমে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি। আট কিলোমিটার পূর্বে নীলকুঠির জন্য বিখ্যাত মালবান্দি। সব মিলিয়ে পাথরায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতেই পারে। তা হলে এখানকার ইতিহাসখ্যাত সুদৃশ্য সব পাথর যেমন রক্ষা পাবে, গড়ে উঠবে দ্রষ্টব্য স্থানও।

    (লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

  • Link to this news (এই সময়)