জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: হুমায়ুন অনেক আগেই তার মা এবং বাবাকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল। তার মানসিক অবস্থা দেখে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খুনের কথা স্বীকার করে নেওয়ায় পুলিস ওই ঘটনায় তথ্য সংগ্রহের উপর জোর দিয়েছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা আগেই বেশকিছু তথ্য পুলিসকে দিয়েছে। তবে হুমায়ুন প্রমাণ লোপাটের জন্য মরিয়া চেষ্টা করেছিল।
মৃত্যুযন্ত্রণা দিতে চেয়েছিল:
ঘুমন্ত অবস্থায় গলায় ছুরি চালালে বাবা যন্ত্রণায় ছটফট করত না। তাতে মৃত্যু হলেও ঠিকমতো শাস্তি হতো না। ছটফটানি দেখার জন্যই বাবাকে ঘুম থেকে তুলে গলার নলি কাটে হুমায়ুন কবীর। পুলিসের জেরায় এমনটাই জানিয়েছে বাবা এবং মা'কে হত্যাকারী মেমারির হুমায়ুন। সে জানিয়েছে, মা মমতা পারভিন বাবাকে খুনের সময় বাধা দিয়েছিল। সেই সময় তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মায়ের মাথা দেওয়ালে ধাক্কা খায়। বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর মায়ের গলার নলিও ছুরি দিয়ে কাটা হয়। এক পুলিস আধিকারিক বলেন, এখন ধৃতকে সামনে বসিয়ে জেরা করা দায় হয়ে উঠেছে। সে আচমকাই মারমুখী হয়ে উঠছে। সামনে যা থাকছে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। তার মনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে, সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান:
বাড়িতে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ওই ক্যামেরাগুলি সে নিজে বাড়ির নিরাপত্তার জন্যই লাগিয়েছিল। ছুরিটিও সে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যায়। বাড়ির পিছনের দিকের দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে যায়। মূল রাস্তা ধরে গেলে পালিয়ে যাওয়ার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিস সহজেই পেয়ে যেত। কিন্তু, উল্টো দিকের রাস্তা ধরায় এই ফুটেজ পেতে তদন্তকারীদের ঝক্কি পোহাতে হয়। খুনের পর বনগাঁ হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার ছক ছিল হুমায়ূনের। কিন্তু, বনগাঁয় নিজের ভুলের কারণেই সে জালে জড়িয়ে যায়। জেরায় সে জানিয়েছে, বনগাঁতে তাকে এভাবে জনতা ধরে ফেলবে বলে সে ভাবতে পারেনি। সেখানে গিয়ে অশান্তি করার কোনও পরিকল্পনাও তার ছিল না। কিন্তু, আচমকায় সে বিবাদে জড়িয়ে যায়। হাতে ছুরি থাকায় কেউই তাকে ধরতে পারবে না বলে তার ধারণা ছিল। কিন্তু কয়েকজন একসঙ্গে জাপটে ধরতেই সে আর পালিয়ে যেতে পারেনি।
আরেক আধিকারিক বলেন, এত কিছুর পরও হুমায়ুন নিজের মেজাজেই রয়েছে। এই ধরণের ঘটনার পুননির্মাণ করতে হয়। কিন্তু, তাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে পুননির্মাণ করা সহজ হবে না। নিজের খেয়াল না হলে সে কোনও কিছুই করতে চাইবে না। এই অবস্থায় তাকে বোঝানোর জন্য মনোবিদের সাহায্য নেওয়া হতে পারে। তারপর বাকি আইনি প্রক্রিয়া করা হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে মেমারিতে আনা হবে। ইতিমধ্যে বর্ধমান পুলিসের একটি দল একাধিকবার বনগাঁয় গিয়ে তাকে জেরা করেছে।
নৃশংস খুনি হুমায়ুন:
খুনের দিন বিকেলে বাবার সঙ্গে নিজেদের পুকুরে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল হুমায়ুন। দু'টি মাছ ধরে আনার পর মাকে তার পছন্দের পদ রান্না করতে বলে। ছেলের ইচ্ছেপূরণ করতে সেটাই করেছিলেন তার মা মমতাজ পারভিন। পেট ভরে খাওয়ার পরই হুমায়ুন তার বাবা ও মাকে নৃশংসভাবে খুনের ছক কষে।
এক প্রতিবেশী বলেন, ওই সন্ধ্যায় মাছ ধরে বাড়ি ফেরার সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়। হুমায়ুন কথা বলেনি। ওর বাবা মোস্তাফিজুর রহমান হাসিমুখে মাথা নেড়েছিল। সে এত বড় কাণ্ড ঘটাতে চলেছে বলে তখনও হুমায়ুনকে দেখে বোঝা যায়নি। পুলিস জানতে পেরেছে, রাতে খাওয়ার পর হুমায়ুনের বাবা ও মা নিজেদের ঘরে ঘুমোতে যান। পাশের রুমে হুমায়ুন ল্যাপটপ দেখছিল। রাত আড়াইটে নাগাদ বাবা ও মায়ের গলায় ছুরি চালিয়ে সে খুন করে!
মারমুখী হুমায়ুন:
এক পুলিস আধিকারিক বলেন, 'তাকে ঠিকভাবে জেরা করাও যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই মারমুখী হয়ে যাচ্ছে। আবার কোনও কোনও সময় তাক লাগানো কথাও বলছে। বিভিন্ন লেখকের বইয়ের রেফারেন্স তুলে কথা বলছে। কেন গরিবদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, তা বইয়ের রেফারেন্সের মাধ্যমে তুলে ধরছে। সমাজে কীভাবে পাপ বা অন্যায় কাজ বন্ধ করা যাবে, তার টিপসও দিচ্ছে সে।'
অতিরিক্ত পুলিস সুপার অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'ওকে হেফাজতে নেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। হেফাজতে পাওয়া গেলে ওকে জেলায় এনে জেরা করা হবে। তবে খুনের কথা সে নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে।'
হুমায়ুনের মানসিক সমস্যা:
আর এক পুলিস আধিকারিক বলেন, 'দিল্লিতে চাকরি করার সময়ই তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রথম দিকে বাড়ির লোকজন তা বুঝতে পারেননি। সে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব বেশি কথা বলত না। কিন্তু, হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে হিমাচল প্রদেশে চলে যাওয়ার পর বাড়ির লোকজন বিষয়টি টের পান। ছেলেকে সুস্থ করার জন্য তার বাবা দিল্লিতে কয়েকমাস ছিলেন। কিন্তু তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন না-হওয়ায় তাকে মেমারিতে এনে চিকিৎসা করা হয়। মাঝে কিছুদিন সে অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত একমাস ধরে তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা বেশি দেখা যায়। সর্বক্ষণ সঙ্গে ছুরি নিয়ে থাকত সে। এ নিয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সে বলত, আত্মরক্ষার জন্য এসব রাখতে হবে। এটা সবারই রাখা দরকার। কিন্তু, আত্মরক্ষার কাজে না লাগিয়ে সেই ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে তার বাবা এবং মাকে খুন করেছে হুমায়ুন!'