• France Riots Cause : রাস্তায় নাগরিকরা, জ্বলছে আগুন! কী কারণে রণক্ষেত্র ফ্রান্স?
    এই সময় | ০১ জুলাই ২০২৩
  • জনবিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ফ্রান্স। মঙ্গলবার পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ১৭ বয়সী আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত নাহেলের। অভিযোগ ওঠে ট্রাফিক সিগন্যালে পুলিশের নির্দেশ না মানলে তাঁর বুকে গুলি চালানো হয়। প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ। পরে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশি গাফিলতির প্রমাণ মেলে। নাহেলের মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ন্যানটেরে, প্যারিস-সহ ফ্রান্সের অন্যান্য় শহরে। একের পর এক গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। অবাধে থানায় হামলা চলে। লুটপাট চলে বিভিন্ন দোকানে।

    এখনও পর্যন্ত দাঙ্গা, লুটপাট ও হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে সাড়ে ছয়শোর বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। দাঙ্গা মোকাবিলায় ফ্রান্সজুড়ে ৪০ হাজারের বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। ফের একবার ফ্রান্স সরকারের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব ও সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে।

    পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেদেশের প্রেসিডেন্ট এমানুয়ের ম্যাক্রঁ জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। গোটা ঘটনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে ম্যাঁক্রো প্রশাসন। মনে করাচ্ছে ২০০৫ সালের ঘটনা। সেই সময়কার ঘটনার এবারও পুনরাবৃত্তি হবে না তো? চিন্তিত প্রশাসন। ২০০৫ সালে দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাবালকের মৃত্যুতে তোলাপাড় পড়ে গিয়েছিল গোটা দেশে। পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল। প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে চলেছিল বিক্ষোভ। দাঙ্গায় গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রায় ৬ হাজার মানুষ। জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করতে হয়েছিল দেশে। তবে এ অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। এর আগেই একই অভিযোগে ২০০৫ সালে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল গোটা ফ্রান্স। মনে করা যাক সেই স্মৃতি।

    কী কারণে ২০০৫-এ বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে গোটা দেশে? ২০০৫ সালের ২৭ অক্টোবরের বিকেল বেলা। জায়েদ বেন্না, বউনা ট্রাওয়রে, মুহিত্তিন আলতুন এবং তাদের আরও ৭ জন বন্ধু ফুটবল খেলছিল একটি মাঠে। রমজানের রোজা ভাঙতে বিকেল ৫টা নাগাদ তারা বাড়ির পথে রওনা দেয়। নির্মীয়মাণ একটি এলাকায় তারা ঢুকে পড়ে। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক বলে মনে হয় স্থানীয় এক বাসিন্দার। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেন। ১০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। ওই যুবকদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের ভয়ে পালিয়ে যায় জায়েদ, বউনা, মুহিত্তিন নামে তিন নাবালক। বৈদ্যুতিক একটি সাবস্টেশনে লুকিয়ে পড়ে তারা। সন্ধ্যা ৬টা ১২ নাগাদ বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যায় জায়েদ (১৭) ও বউনা (১৫)। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার হয় মুহিত্তিন (১৭)। চিৎকার করে সাহায্যের আর্তি জানালেও পুলিশের তরফে কোনওরকম সাহায্য মেলেনি বলে অভিযোগ ওঠে। পুলিশের গা-জোয়ারিতেই দুই নাবালকের বেঘোরে প্রাণ গিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেদিনের নাবালকের মৃত্যু তোলপাড় ফেলে দেয় দেশে। ঘটনার পর পরই প্রথম বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে ক্লিটি সুইস বয়েসে।

    ঘটনার পর দিন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে। তিনি চুরির অভিযোগ তোলেন মৃতদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে পুলিশ জানায়, মৃতদের বিরুদ্ধে চুরি বা সরকারি সম্পত্তি নষ্টের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপরই ওই দিন বিকেলে আরও জোরদার হয় দাঙ্গা। পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে উত্তেজিত জনতা। জায়গায় জায়গায় শুরু হয় পাথরবৃষ্টি। পুলিশের বিরুদ্ধে সত্য় গোপনের পাশাপাশি ওই নাবালকদের কোনওরকম সাহায্য না করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পাল্টা কড়া হাতে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা চলে পুলিশের তরফেও। এরই মধ্যে ওই একই দিন বিকেলবেলা একটি মসজিদের সামনে কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটায় পুলিশ। সেসময় প্রচুর মানুষের ভিড় ছিল মসজিদের সামনে। তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

    প্রথমে প্যারিসে বিক্ষোভ সীমাবদ্ধ থাকলেও পড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে ইলে-ডি-ফ্রান্স, অন্যান্য শহরে। হাজার হাজার গাড়ি পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। ৮ নভেম্বরের মধ্যরাত থেকে দেশে জরুরি অবস্থা কার্যকর হয়।

    তা সত্ত্বেও জায়গায় জায়গায় দাঙ্গা চলতে থাকে । পরের দিকে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হয়। ৯ ও ১০ নভেম্বর বেলফোর্টে একটি স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিদ্য়ুতের সাবস্টেশগুলিতে হামলা চলে। তিন সপ্তাহ ধরে চলা সেই বিক্ষোভে ৩০০ জেলায় প্রায় ১০ হাজার গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ২৩৩ টি সরকারি ভবন ও ৭৪টি ব্যক্তিগত ভবন। সেই বিক্ষোভ নিয়ে দেশে বিস্তর জলঘোলা হয়। আইনি টানাপোড়েন চলে। ঘটনার ১০ বছর পর ২০১৫ সালে দু'জন পুলিশ আধিকারিক ফৌজদারি আদালতে হাজিরা দেন। বিপদগ্রস্ত ব্য়ক্তিদের সহায়তা প্রদানে ব্যর্থতার অভিযোগ ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে। পরে তারা বেকসুর খালাস পান।

    নাহালের মৃত্যুর চারদিন পেরিয়ে গেলেও এখনও চলছে বিক্ষোভ। বিক্ষোভের রেশ কতদিন থাকবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে সে আঁচ ইতিমধ্যেই করতে পেরেছে সে দেশের সরকার। পরিস্থিতি সামালে তড়িঘড়ি চেষ্টাও চালানো হচ্ছে ফ্রান্স সরকারের তরফে। বর্তমানে নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবিদ্বেষ ও সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের বিতর্ককে ফের একবার উস্কে দিল।
  • Link to this news (এই সময়)