• Parliament Session : আচ্ছা হরিদাস পাল, আপনি অসংসদীয়?
    এই সময় | ০২ আগস্ট ২০২৩
  • এই সময়: ইভ টিজিং গণ্য হতে পারে কোনও মহিলাকে 'কে তুমি নন্দিনী' বললে। সেই মহিলা অভিযোগ করতেই পারেন যে, তাঁকে তির্যক ভঙ্গিতে 'আওয়াজ' দিয়েছে বা 'টন্ট' করেছে বখাটেরা। কিন্তু পাড়ায় রকের আড্ডা থেকে 'নন্দিনী' আওয়াজ নয়, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বলা হয়েছে 'হরিদাস পাল'। রাজনৈতিক গোল বেঁধেছে তা নিয়েই। মঙ্গলবার তো শাসক-বিরোধী দু'পক্ষের প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়েছে 'হরিদাস পাল' কথাটা অসংসদীয় কি না, সেই ব্যাপারে। ২০১৩-র মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যেমন এক মহিলা সদস্য 'চুদুরবুদুর' কথাটা বললে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, এ বার বাংলার বিধানসভাতেও তেমন হরিদাস পাল নিয়ে অতটা না-হলেও ভালো মতো চর্চা শুরু হয়েছে।

    কিন্তু প্রশ্নটা হলো, কে এই হরিদাস পাল? 'লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন' থেকে অনুমান করা যায়, গৌরী সেন প্রবল অর্থবান কেউ। আর 'কে তুমি হরিদাস পাল' কিংবা 'তুমি কোন হরিদাস পাল'-এর মতো উক্তি থেকে ধরে নেওয়াই যায় যে, হরিদাস পাল হোমরা-চোমরা বা গণ্যমান্য কেউ। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় সেই হরিদাসের নামে একটি সরু গলিরাস্তা রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে শুরু হয়ে হরিদাস পাল স্ট্রিট বইপাড়ার মধ্যে দিয়ে শ্যামচরণ দে স্ট্রিটে গিয়ে শেষ হয়েছে। আগে যে রাস্তার নাম ছিল কলেজ লেন। তা হলে নিশ্চয়ই বাস্তবে কোনও হরিদাস পাল ছিলেন। কে তিনি?

    এই নিয়ে দু'টো মত ঘুরপাক খায়। প্রথম মতটা হলো: হুগলির রিষড়ায় ১৮৭৬-এ জন্মানো হরিদাস পাল তাঁর ১৬ বছর বয়সে, ১৮৯২-তে কলকাতায় এসে কাজ নিয়েছিলেন শোভাবাজার এলাকায় সোনার দোকানে। আচমকাই হরিদাস লটারি জেতার মতো পেয়ে যান তাঁর নিঃসন্তান মামার সম্পত্তি- সেই মামার মৃত্যুর পর একমাত্র অধিকারী হিসেবে। তার পর বড়বাজারে নিজে কাচ ও লণ্ঠনের বড় ব্যবসা ফেঁদেছিলেন তিনি, সেই ব্যবসা ছড়িয়েছিল গুয়াহাটিতেও। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল অট্টালিকা।

    দান-ধ্যান ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করা এবং দয়ালু সেই হরিদাস ৫৭ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে মারা যান। দ্বিতীয় মত হলো: সাবেক পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশের হরিপুরের লোক ছিলেন হরিদাস পাল। তাঁর পূর্বপুরুষরা ইংরেজদের মোসাহেবি করে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। বিপুল টাকাপয়সা নিয়ে হরিপুর থেকে কলকাতায় এসে হরিদাস প্রচুর সম্পত্তি কেনেন, ব্যবসা শুরু করেন এবং পরে নিঃস্ব হয়ে যান। ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য, 'উনিশ শতকে হরিদাস পাল কলকাতার এক জন বড়লোক ছিলেন।

    বিত্তশালী হওয়ার কারণে লোকে তাঁকে সম্ভ্রমের চোখে দেখত। বইপাড়ায় সেই হরিদাস পালের নামে রাস্তাও রয়েছে।' ইতিহাসবিদ কিংশুক চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, 'বাস্তবে এমন কারও অস্তিত্ব সত্যিই ছিল কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, হরিদাস পাল কোনও সাহিত্যের চরিত্র ছিল। সেখান থেকে এই নামটা লেজেন্ড বা কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে।'

    সেই হরিদাস পাল বাঙালির লব্জে এখনও জীবন্ত। তর্কবিতর্ক হলে এক জন অন্য জনকে, এমনকী পারিবারিক বিবাদেও বলা হয়, কে তুমি (বা আপনি) হরিদাস পাল? অর্থাৎ, তুমি নিজেকে বড় মনে করছ? আসলে তুমি আদৌ তা নও। কিংবা তুমি (বা আপনি) কোন হরিদাস পাল? মানেটা হলো, কী কারণে তোমাকে এত গুরুত্ব দিতে হবে?

    বিধানসভায় মণিপুর নিয়ে বিতর্কে সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম না-করে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি পরিষদীয় দলকে হরিদাস পাল বলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকেই গেরুয়া ব্রিগেড অসংসদীয় শব্দ বলে দাবি করেছে, মঙ্গলবার বিজেপির বিধায়ক সুদীপ মুখোপাধ্যায় উপাধ্যক্ষ আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হরিদাস পাল শব্দবন্ধ বিধানসভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান।

    তবে পোড় খাওয়া তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়ের পাল্টা বক্তব্য, 'হরিদাস পাল কোনও অসংসদীয় শব্দ নয়। যদি ওঁরা (বিজেপি) মনে করেন, এটা অসংসদীয় শব্দ, তা হলে এই নিয়ে আলোচনা হতে পারে।' এই যুক্তি মানতে নারাজ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর কথায়, 'এঁদের কাছে হরিদাস পাল অসংসদীয় শব্দ নয়। কেউ বিধানসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করার কথা বললেও তা অসংসদীয় নয়!'

    তবে ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য, 'হরিদাস পাল কোনও অসংসদীয় শব্দ নয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেই কাউকে হরিদাস পাল বলা হয়।' ১০ বছর আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সেই গোলমালের সময়েও পবিত্র সরকার জানিয়েছিলেন, 'চুদুরবুদুর' গ্রাম্য শব্দ- অশ্লীল নয়। ইতিহাসবিদ কিংশুক চট্টোপাধ্যায় বলছেন, 'হরিদাস পাল বলা হয় কাউকে তাচ্ছিল্য করতে। এখন তো সংসদে এর চেয়ে অনেক খারাপ শব্দ দিব্যি ব্যবহার করা হচ্ছে।'
  • Link to this news (এই সময়)