• রাক্ষুসে দুর্ভিক্ষকে পরাজয়ের লক্ষ্য নিয়েই মহামায়া আরাধনা ‘মহাত্রাণ’ শান্তিরামের
    বর্তমান | ১০ অক্টোবর ২০২৩
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, আরামবাগ:  ছিয়াত্তরের রাক্ষুসে দুর্ভিক্ষকে নিজের এলাকায় পরাভুত করেছিলেন জমিদার শান্তিরাম রায়। আরামবাগের মাধবপুরের জমিদার ছিলেন তিনি। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের কাহিনি আজও মুখে মুখে ঘোরে। জনহিতের জন্য শান্তিরাম দেবী দুর্গার আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। প্রজাহিতৈষী এই জমিদারকে বর্ধমানের রাজা ‘মহাত্রাণ’ উপাধিও দিয়েছিলেন। শতাব্দী প্রাচীন এই রায়বাড়ির পুজোয় আজও দেবী দুর্গার কাছে অশুভ শক্তির বিনাশের প্রার্থনা করা হয়।

    গড়বাড়ির রাজা রনজিৎ রায়ের বংশধর মাধবপুরের জমিদার পরিবার। মুঘল ও আফগান লড়াইয়ের সময়কালে গড় মান্দারণের সঙ্গে গড়বাড়ি দূর্গ ধ্বংস হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা হুগলী জেলার হামীরবাটী , শ্যামবাটী, মাধবপুর, গোপীনাথপুর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। রনজিৎ রায়ের বংশধরদের একটি শাখা আরামবাগের মাধবপুর এলাকায় ভদ্রাসন গড়ে তোলেন। এই বংশের শান্তিরাম রায় বর্ধমান রাজ কর্তৃক ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বায়রা পরগনা, বদনগঞ্জ, উচালন ও পহলানপুরের জমিদারি পান। সেই সময়কালে বাংলাজুড়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর শুরু হয়। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে গ্ৰামের পর গ্ৰাম মৃত্যুমিছিল হতে থাকে। সন্তানসম প্রজাদের রক্ষায় শান্তিরাম ঝাঁপিয়ে পড়েন। জমিদার বাড়ির শস্য ভাণ্ডার সকলের জন্য খুলে দেন তিনি। একই সঙ্গে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে মা দুর্গার আরাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন শান্তিরাম। সফল হয়েছিলেন তিনি। মন্বন্তরের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন। বর্ধমান মহারাজ প্রজাহিতৈষী এই কাজের জন্য শান্তিরামকে ‘মহাত্রাণ’ উপাধি প্রদান করেন। 

    ছোট্ট সেই মাধবপুরের শাসকের কথা আজও লোকমুখে ছড়িয়ে রয়েছে। ১৭৯২ সালে জমিদার বাড়িতে দেবী দুর্গার ঠাকুর দালান নির্মিত হয়। দুই শতাব্দী ধরে সেই ঠাকুর দালানে আজও পুজো হয়ে আসছে। শান্তিরামের অষ্টম পুরুষ শুভদীপ রায় বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষরা রাজপুত গোষ্ঠীর চান্দেলা প্রতিহার বংশের ছিলেন। এই বংশের একটা শাখা বর্তমান বিহারের মুঙ্গের জেলার গিধাউরি এলাকার শাসক ছিল। সেই বংশের সংগ্ৰাম সিং গৌড় অধিপতির কাছে রায় উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর ছেলে রঞ্জিত রায় সম্ভবত গড় মান্দারণের সমরশাসক বা অন্য কোনও উচ্চপদের দায়িত্বে ছিলেন। মুঘল-আফগান যুদ্ধে এই বংশের সদস্য হরিশ্চন্দ্র রায় মারা যান। পারিবারিক নথিপত্রে প্রাচীন এই ইতিহাস থেকে গিয়েছে। যদিও মূল স্রোতের ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ে সেই সব স্থান পায়নি। পরিবারের ঐতিহ্য ও রীতি মেনেই আমাদের এই পুজো এখনও হয়।’

    বাড়ির অপর সদস্য অমলেন্দু রায় বলেন, ‘আমাদের পুজো শুরু হয় কৃষ্ণ নবমী কল্পারম্ভ দিয়ে। নবমী থেকে নবমী বিশেষ অনুষ্ঠান ও পুজো হয়। এই পুজোর বিশেষত্ব হল দশভূজা মূর্তিতে কুলদেবী বিশালক্ষীকে আরাধনা করা। রাজা রণজিতের ব্যবহৃত তরবারি ক্ষত্রিয় বংশ ও ক্ষাত্র তেজের প্রতীক হিসেবে পুজো করা হয়। পুজোতে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত বিশেষ মহাদুর্গা হোম হয় ১০০৮ আহুতি সহ। এই হোমাগ্নি তিন দিনব্যাপী জ্বলতে থাকে। দশমীতে বিশেষ রীতি অনুযায়ী মহামন্ত্র পাঠ করা হয়। ঘট নিরঞ্জনের আগে এক বিশেষ প্রথা অনুসারে আজও খাজনা নেওয়া হয়। আগে পঞ্চ মোষ, ছাগ, ইক্ষু, চাল কুমড়ো বলি হতো। এখন মোষ বলি হয় না। সামবেদ অনুযায়ী এই বাড়ির দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। আমরা প্রার্থনা করি মহামায়া তুষ্ট হোন।’ 
  • Link to this news (বর্তমান)