সোমবার হুগলির আরামবাগে সরকারি কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন মমতা।
সঙ্গে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন দেবকে। বানভাসি ঘাটালকে বাঁচাতে বার বার দেব সংসদে সরব
হয়েছেন। ‘ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান’-এর দাবি তুলেছেন।
অভিযোগ, কেন্দ্রের গাফিলতির কারণেই তা হয়নি। এ বার আরামবাগে সরকারি কর্মসূচিতে
দাঁড়িয়ে সেই ‘মাস্টারপ্ল্যান’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই আর্জি জানালেন ‘ভাই’ দেব।
আর সেটাই মেনে নিলেন মমতা। দেবের কথায়, ‘‘২০২৪ সালে আমি জিতব, কি জিতব না, জানি
না। তবে দিদির কাছে অনুরোধ, কেন্দ্রের ভরসায় না থেকে রাজ্য সরকারই
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তৈরি করুক। স্বাধীনতার আগে থেকে এটা ঘাটালের মানুষের
স্বপ্ন। চাইব, দিদি সেই স্বপ্ন পূরণ করুন।’’ জবাবে মমতা
বললেন, ‘‘দিদির কাছে ভাই আবদার করলে তো দিদি ফেরাতে পারে না। আমি ইতিমধ্যেই
নির্দেশ দিয়েছি ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে। দিল্লির ভরসায় থাকব না। আমরা
আমাদেরটা করে নেব।’’
‘দিদি-ভাই’-এর এই মন্তব্যের মাধ্যমেই আরও একটি ‘চুক্তি’ হয়ে
গেল— আপাতত রাজনীতিতেই থাকছেন দেব। আর সম্ভবত প্রার্থী হচ্ছেন সেই ঘাটালেই। দেবের
কথাতেও তা স্পষ্ট হয়েছে আরও এক বার। তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়েই বলেন, ‘‘দিদির হাত ধরে
রাজনীতিতে এসেছিলাম। দিদির হাত ধরেই থেকে গেলাম। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী
দিদি।’’
দিন কয়েক আগে ঘাটালের তিনটি
প্রশাসনিক পদ— ঘাটাল কলেজ, ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি ও বীরসিংহ উন্নয়ন পর্ষদের
চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন সাংসদ দেব। তার পরেই
তৈরি হয় জল্পনা। তবে কি ঘাটালে আর প্রার্থী হচ্ছেন না দেব? তবে কি এ বার রাজনীতি
থেকেও ইস্তফা? জানুয়ারির শুরুতে মমতা যদিও স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, দেবই হতে চলেছেন
ঘাটালের প্রার্থী। কালীঘাটে মমতার নেতৃত্বে বৈঠক বসেছিল। তৃণমূলের পশ্চিম
মেদিনীপুরের জেলা কমিটির বৈঠকে সাংসদ হিসেবে হাজির হয়েছিলেন অভিনেতা দেব। সেখানেই
তাঁকে ফের ঘাটালে প্রার্থী করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মমতা। আর দলনেত্রীর নির্দেশ
থাকলে তিনিও যে ফের লোকসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে প্রস্তুত, পাল্টা সেই ইঙ্গিত দেন দেবও। তাঁকে দলের
‘সম্পদ’ বলেন দলনেত্রী। তার পরেও ঘাটালের তিনটি প্রশাসনিক পদ থেকে ইস্তফা।
এর পর লোকসভার বাজেট
অধিবেশনের শেষ দিন দেবের পোস্ট তাঁর প্রার্থী না হওয়ার জল্পনা উস্কে দেয়। তিনি সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘সংসদে আমার শেষ দিন।” এতেই
অনেকের মনে হয়েছিল, ঘাটাল থেকে আসন্ন লোকসভায় দেব যে আর
দাঁড়াতে চাইছেন না। যদিও সরাসরি এ ব্যাপারে কখনওই কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা
জানাননি দেব। এর মধ্যেই গত শনিবার বিকেলে শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেন দেব।
তবে মমতা বা অভিষেকের সঙ্গে দেবের কী আলোচনা হয়েছে, তা
স্পষ্ট নয়। মমতা, অভিষেক বা দেব কেউই সে ব্যাপারে প্রকাশ্যে
কোনও মন্তব্য করেননি। তবে জোড়া বৈঠক সেরে দেবের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, “আমি ছাড়তে চাইলেও রাজনীতি আমাকে ছাড়বে না!”
দলের একটি
অংশের মত,
দেবকে নিয়ে টানাপড়েনের মূলে ছিল সাংসদের সঙ্গে ঘাটালের প্রাক্তন
বিধায়ক শঙ্কর দলুইয়ের ‘শীতল সম্পর্ক’। দিন কয়েক আগে এই সংক্রান্ত একটি অডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ্যে আসে। তাতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, দেব নাকি তাঁর কাছ থেকে
এমপি ল্যাড (সাংসদ তহবিল)-এর ৩০ শতাংশ কমিশন চেয়েছেন। ওই ব্যক্তির কথায়, ‘‘আমি দিদিকে এমন কথা বলেছি যে, দেব আমার কাছ থেকে
তাঁর এমপি ল্যাড থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন চাইছেন। দিদি বলেছেন, ‘ছেড়ে
দে। ওর কাজটা করিস না।’ কিন্তু আমি তো দিদিকে বলেছি। দিদি
জানে। সব দেখেও তো ওকে সাপোর্ট করেছেন। কেন করেছেন? ওকে আবার
রাজনীতিতে প্রয়োজন। কাজেই ভালমন্দ, এখানে সততা বলে কিছু
নেই। সততার মূল্য নেই। যে যত চুরি জোচ্চুরি-বাটপাড়ি করতে পারবে, তারাই গিয়ে ওই...।’’ বিরোধীদের দাবি, অডিয়ো ক্লিপের কণ্ঠস্বর যাঁর, তিনি শঙ্কর। শঙ্কর অবশ্য দাবি করেছেন, ওই কণ্ঠস্বর তাঁর নয়।
ওই অডিয়ো
ক্লিপ প্রসঙ্গে দেব জানান, যে হেতু ওই ব্যক্তির সঙ্গে দিদি (মমতা)-র কথা হয়েছে,
তাই যা উত্তর দেওয়ার দিদিই দেবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার উপর কিছু নির্ভর করে নেই। আমার যা করার, যা
বলার, তা আমি দলকে বলে দিয়েছি। যে অডিয়ো ক্লিপটি বেরিয়েছে,
সেই মতো দেখলে, দিদি আর ওর মধ্যে কিছু কথা
হয়েছ। দিদিই উত্তরটা দেবেন। আমার কিছু বলার নেই।’’ তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, শঙ্করের সঙ্গে বিবাদের কারণে দেব
রাজনীতি নিয়ে কিছুটা ‘বীতশ্রদ্ধ’ হয়েছিলেন।
নেতৃত্বও তা জানতেন। সম্প্রতি ঘাটাল উৎসব ও শিশু মেলার কমিটি গঠন নিয়ে ওই বিতর্ক
চরমে পৌঁছয়। তা-ও শীর্ষ নেতৃত্বের কানে পৌঁছেছিল। এর পরেই দেবের তিনটি প্রশাসনিক
কমিটি থেকে ইস্তফা, সমাজমাধ্যমে পোস্ট। গত শনিবার দেখা করেন মমতা এবং অভিষেকের
সঙ্গে। সেই আবহে ঘাটাল সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানো হয়
শঙ্করকে। শঙ্করের জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয় ডেবরার প্রাক্তন বিধায়ক রাধাকান্ত
মাইতিকে। রাধাকান্ত আগে ডেবরা ব্লক সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। মনে করা হচ্ছে, তার
পরেই দেবের ‘সিদ্ধান্তবদল’। বিজেপি সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে হাসপাতাল থেকে দেখে
বেরিয়ে তিনি জানিয়ে দেন, রাজনীতি তাঁর পিছু ছাড়ছে না। সোমবার আরামবাগে আবার
বললেন, তৃণমূল নেত্রীর হাত ধরেই রাজনীতিতে থেকে গেলেন তিনি।